DailySangram-Logo

কলাম

আল কুরআনে ডানপন্থি ও বামপন্থিদের পরিচয়

আল কুরআনের দৃষ্টিতে ডানপন্থি ও বামপন্থিদের পরিচয় নিম্নরূপ: আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তারপর (এই সঙ্গে) তাদের মধ্যে শামিল হওয়া যারা ঈমান এনেছে এবং যারা পরস্পরকে সবর ও (আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি) রহম করার উপদেশ দেয়। এরাই ডানপন্থি।

Printed Edition

জাফর আহমাদ

আল কুরআনের দৃষ্টিতে ডানপন্থি ও বামপন্থিদের পরিচয় নিম্নরূপ: আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তারপর (এই সঙ্গে) তাদের মধ্যে শামিল হওয়া যারা ঈমান এনেছে এবং যারা পরস্পরকে সবর ও (আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি) রহম করার উপদেশ দেয়। এরাই ডানপন্থি। আর যারা আমার আয়াত মানতে অস্বীকার করেছে তারা বামপন্থি। এদের ওপর আগুন ছেয়ে থাকবে।” (সুরা আল বালাদ : ১৭-২০)

ডানপন্থিদের পরিচয়: ডানপন্থি হওয়ার জন্য প্রথমত ঈমানদার হওয়া জরুরি। কারণ ঈমান ছাড়া কোন কাজ সৎকাজ হিসাবে চিহ্নিত হতে এবং আল্লাহর কাছে গৃহীত হতে পারে না। কুরআনের বিভিন্নস্থানে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ঈমান সহকারে যে সৎকাজ করা হয় একামত্র সেটিই নেকী ও মুক্তির উপায় হিসেবে গৃহীত হয়। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন: “পুরুষ বা নারী যে ব্যক্তিই সৎকাজ করে সে যদি মু’মিন হয়, তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (সুরা নিসা : ১২৪) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, “পুরুষ বা নারী যে ব্যক্তিই সৎকাজ করবে, সে যদি মু’মিন হয় তাহলে আমি তাকে পবিত্র জীবন যাপন করাবো এবং এ ধরনের লোকদেরকে তাদের সর্বোত্তম কাজ অনুযায়ী প্রতিদান দেবো।” (সুরা নাহল : ৯৭) কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ বলেন, “পুরুষ বা নারী যে সৎকাজ করবে সে যদি মু’মিন হয় তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সেখানে তাকে দেয়া হবে বেহিসেব রিযিক।” (সুরা : মু’মিন : ৪০) এভাবে কুরআনের যেখানেই সৎকাজ ও তার উত্তম প্রতিদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেখানেই অবশ্যই তার সাথে ঈমানের শর্ত লাগানো হয়েছে।

ডানপন্থিরা ডানপন্থি হওয়ার জন্য উল্লেখিতদের দলভুক্ত হতে হবে। অর্থাৎ ঈমানদারদের একটি জামা’আত হবে। উল্লেখিত আয়াতে প্রথমেই বলা হয়েছে “তারপর সে ঈমানদারদের মধ্যে শামিল হয়েছে। একথা বলা হয়নি যে, সে ঈমান এনেছে। এর অর্থ হয়, নিছক এক ব্যক্তি হিসাবে তার নিজের ঈমান আনাই কেবলমাত্র এখানে উদ্দেশ্য নয় বরং এখানে মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্রত্যেক ব্যক্তি ঈমান এনেছে সে দ্বিতীয় ব্যক্তি যে ঈমান এনেছে তার সাথে শামিল হয়ে যাবে। এর ফলে ঈমানদারদের একটি দল তৈরি হয়ে যাবে। মু’মিন একটি সমাজ গড়ে উঠবে। সামগ্রীক ও সমাজবদ্ধভাবে নেকী, সততা ও সৎবৃত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, যেগুলো প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল ঈমানের দাবি। অন্যদিকে অসৎবৃত্তি ও পাপ নির্মূল হয়ে যাবে, যেগুলো খতম করাই ছিল ঈমানের মৌলিক চাহিদার অন্তর্ভুক্ত।

উল্লেখিত আয়াতে ছোট ছোট বাক্যে ডানপন্থিদের গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ডানপন্থি সমাজের সদস্যরা পরস্পরকে সবর করার উপদেশ দেবে এবং দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা পরস্পরকে রহম ও পরস্পরের প্রতি স্নেহার্দ্র ব্যবহারের উপদেশ দান করবে।

ডানপন্থিদের প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তাদের সমাজের প্রতিটি সদস্য পারস্পরিক সবরের উপদেশ দেয়। আল কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে বার বার সবরের কথা বলা হয়েছে। সবর শব্দটি আল কুরআনে যে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সে দৃষ্টিতে বিচার করলে মু’মিনের সমগ্র জীবনকেই সবরের জীবন বলা যায়। ঈমানের পথে পা রাখার সাথে সাথেই মানুষের সবরের পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। আল্লাহ যেসব ইবাদাত ফরয করেছেন, সেগুলো সম্পাদন করতে গেলে সবরের প্রয়োজন। আল্লাহর বিধানের আনুগত্য করার এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সবরের দরকার। আল্লাহ যেগুলো হারাম করেছেন সবরের সাহায্য ছাড়া সেগুলোর হাত থেকে রেহাই পাওয়া কঠিন। নৈতিক অসৎবৃত্তি পরিহার করা ও সৎবৃত্তি অবলম্বন করার জন্য সবরের প্রয়োজন। প্রতি পদে পদে গোনাহ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। তার মোকাবেলা করা সবর ছাড়া সম্ভব নয়। জীবনের এমন বহু সময় আসে যখন আল্লাহর আইনের আনুগত্য করলে ও তার প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে নিয়োজিত হলে বিপদ-আপদ, কষ্ট, ক্ষতি ও বঞ্চনার সম্মুখীন হতে হয়। ইসলামের ইতিহাস এই সাক্ষ্যই বহন করে আসছে।

আবার বিপরীত চিত্রও আমরা হরহামেশা বাস্তব চোখে দেখে আসছি যে, বামপন্থিদের মতো নাফরমানির পথ অবলম্বন করলে লাভ, ফায়দা, আনন্দ ও ভোগের পেয়ালা উপচে পড়ে। সবর ছাড়া কোন মু’মিন এ পর্যায়গুলো নির্বিঘ্নে অতিক্রম করতে পারে না। তারপর ঈমানের পথ অবলম্বন করতেই মানুষ বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। নিজের সন্তান-সন্তুতির, নিজের পরিবারের, সমাজের, দেশের, জাতির ও সারা দুনিয়ায় মানুষ ও জি¦ন শয়তানদের। এমনকি তাকে আল্লাহর পথে হিজরত এবং জিহাদ করতে হয়। এসব অবস্থায় একমাত্র সবরের গুণই মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল রাখতে পারে। তবে কোন মু’মিন একা একা এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করা কঠিন। বরং ডানপন্থিদের একটি সমাজ থাকবে, যার প্রত্যেকটি সদস্য সবরকারী হয় এবং এই সমাজের প্রত্যেক সদস্য পারস্পরিক সবরের উপদেশ দেবে। তাহলে সাফল্য এই সমাজের পদতলে লুটিয়ে পড়বে। সেখানে পাপ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সীমাহীন শক্তির প্রবাহ সৃষ্টি হবে। এভাবে মানুষের সমাজকে ন্যায়, সততা ও নেকীর পথে আনার জন্য একটি জবরদস্ত শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরী হয়ে যাবে।

ডানপন্থিদের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা (আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি) রহম করার উপদেশ দেয়। এ সমাজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এটা কোন জালেম, নির্দয়, বেরহম, পাষাণ হৃদয় ও হৃদয়হীনদের সমাজ হয় না। বরং সমগ্র মানবতার জন্য এটি হয় একটি স্নেহশীল, করুণাপ্রবণ এবং নিজেদের পরস্পরের জন্য সহানুভূতিশীল ও পরস্পরের দুঃখে-শোকে-বেদনা অনুভবকারী একটি সংবেদনশীল সমাজ। ব্যক্তি হিসেবেও একজন মু’মিন হয় আল্লাহর করুণার মূর্ত প্রকাশ এবং দলগতভাবেও মু’মিনদের দল আল্লাহর এমন এক নবীর প্রতিনিধি যার প্রশংসায় বলা হয়েছে, “তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত ও করুণা হিসেবেই পাঠিয়েছি।” (সুরা আম্বিয়া : ১০৭) নবী (সা:) নিজের উম্মাতের মধ্যে এ রহম ও করুণাবৃত্তিটির মতো উন্নত নৈতিক বৃত্তিটিকেই সবচেয়ে বেশি প্রসারিত ও বিকশিত করতে চেয়েছেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ তাঁর নিম্নোক্ত বাণীগুলো দেখুন।

জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: আল্লাহ তার প্রতি রহম করেন না, যে মানুষের প্রতি রহম করে না। (বুখারী : ৭৩৭৬, তাওহীদ প্রকাশনী, কিতাবুত তাওহীদ, বাবু বা পরিচ্ছদ : তুমি বলে দাও, তোমরা যে নামে ডাকো বা রাহমান নামে ডাকো। তোমরা যে নামেই ডাকো সকল সুন্দর নামই তাঁর।, আ.প্র: ৬৮৬০, ইফা : ৬৮৭২)

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: দয়াশীলদের উপর করুণাময় আল্লাহ দয়া করেন। তোমরা দুনিয়াবাসীকে দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদেরকে দয়া করবেন।(আবু দাউদ:৪৯৪১,কিতাবুল আদব, বাবু ফির রাহমাহ, তিরমিযি, আহমাদ, হাদীসটি সহীহ)

ডান ও বামপন্থিদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “সে সময় তোমরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। ডান দিকের লোক। ডান দিকের লোকদের (সৌভাগ্যের) কথা আর কতটা বলা যাবে। বাম দিকের লোক, বাম দিকের লোকদের (দুর্ভাগ্যের) পরিণতি আর কি বলা যাবে।” (সুরা ওয়াকিয়া:৭-৯) মূল ইবারতে “আসহাবুল মাশআমা” ব্যবহৃত হয়েছে। মাশআমা শব্দের উৎপত্তি হয়েছে শাউম থেকে। এর অর্থ দুর্ভাগ্য, কুলক্ষণ, অশুভ লক্ষণ। আরবী ভাষায় বাঁ হাতকে শাউমি বলা হয়। আরবরা শিমাল (বাঁ হাত) এবং শাউম (অশুভ লক্ষণ) শব্দ দুটোকে সমার্থক মনে করতো। তাদের কাছে বাঁ হাত দুর্বলতা ও লাঞ্ছনার প্রতীক। সফরে রওয়ানা হওয়ার সময় যদি পাখি তাদের বাঁ হাতের দিক দিয়ে উড়ে যেতো তাহলে তারা একে অশুভ লক্ষণ বলে মনে করতো। কাউকে বাঁ পাশে বসালে তার অর্থ হতো সে তাকে নীচু মর্যাদার লোক মনে করে। বাংলা ভাষাতেও খুব হালকা ও সহজ কাজ বুঝাতে বলা হয়, এটা আমার বাঁ হাতের খেলা। অতএব আসহাবুল মাশআমা অর্থ দুর্ভাগা লোক অথবা এমন লোক যারা আল্লাহর কাছে লাঞ্ছনার শিকার হবে এবং আল্লাহর দরবারে তাদেরকে বাম দিকে দাঁড় করানো হবে। এরাই দুর্ভাগা বামপন্থি। হে আল্লাহ! আমাদেরকে এই বামপন্থিদের অন্তর্ভুক্ত করো না।

লেখক : আলেমে দ্বীন ও ব্যাংকার।