DailySangram-Logo

কলাম

মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদলাতে চায় নেতানিয়াহু!

গাজায় যুদ্ধবিরতি চললে পশ্চিম তীরের জেনিন উদ্বাস্তু শিবিরে দু’সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ইসরাইলের বর্বর হামলা ও ধ্বংস অব্যাহত থাকার মধ্যে নেতানিয়াহুকে নিয়ে ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় বিমান উইং অব জায়োন সোমবার ওয়াশিংটন পৌঁছায়। সেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানায় ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত স্টিভ উইটকিন।

Printed Edition

॥ মো: সাজ্জাদুল ইসলাম ॥

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করতে ইসরাইলের রক্তপিপাসু প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি ওয়াশিংটন যাওয়ার সময় বলেছেন, ট্রাম্প ২০ জানুয়ারি হোয়াইট হাউসে ক্ষমতা গ্রহণ করার পর তিনিই প্রথম বিদেশী সরকারপ্রধান হিসেবে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল অতি ঘনিষ্ঠ মিত্রতাপূর্ণ সম্পর্কের ‘একটি বড় প্রমাণ’। এ ছাড়া এটি আমাদের দু’জনের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বেরও প্রমাণ বহন করছে। টাইমস অব ইসরাইল একথা জানিয়েছে।

গাজায় যুদ্ধবিরতি চললে পশ্চিম তীরের জেনিন উদ্বাস্তু শিবিরে দু’সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ইসরাইলের বর্বর হামলা ও ধ্বংস অব্যাহত থাকার মধ্যে নেতানিয়াহুকে নিয়ে ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় বিমান উইং অব জায়োন সোমবার ওয়াশিংটন পৌঁছায়। সেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানায় ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত স্টিভ উইটকিন। নেতানিয়াহু দাবি করেন যে, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে যে যুদ্ধ শুরু করেছেন তা ইতোমধ্যে অঞ্চলটির চেহারা বদলে দিয়েছে। তাদের সেনারা বদলে দেওয়ার এ কাজটি করেছে। তিনি বলেন, ‘আমার বিশ^াস প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারলে আমরা আমাদের স্বার্থে মধ্যপ্রাচ্যকে আরও বদলে দিতে পারবো। এর মধ্যদিয়ে আমরা আমাদের নিরাপত্তা জোরদার, শান্তির ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করতে এবং শান্তি ও শক্তিমত্তার নতুন যুগ গড়ে তুলতে পারবো।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সঙ্গে আলোচনায় ‘অগ্রগতি হচ্ছে’। সম্প্রতি ওয়াশিংটনে নেতানিয়াহুর সঙ্গে গাজার যুদ্ধবিরতির পরবর্তী ধাপ নিয়ে আলোচনায় বসার দুই দিন আগে তিনি এ মন্তব্য করেন। ট্রাম্প বলেন, নেতানিয়াহু আসছেন। তার সঙ্গে তার দীর্ঘ আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। ইসরাইলী মিডিয়া কান জানায়, নেতানিয়াহু তার বক্তব্যে দৃশ্যত সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন। নেতানিয়াহু সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন প্রশ্নে আলোচনার জন্য একটি আলোচক দল গঠনের চেষ্টা করছেন। কান আরও জানায়, ট্রাম্প প্রশাসন তাদের তথাকথিত ‘মধ্যপ্রাচ্যের স্বর্ণযুগ’ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সৌদি আরব ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তি স্থাপন দেখতে চায়।

এরআগে মার্কিন প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকাতায় আব্রাহাম একোর্ড এর আওতায় ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কো ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনা করেছে। এর আওতা এখন ওয়াশিংটন আরও সম্প্রসারিত করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী টার্গেট সৌদি আরব ও কাতার। গাজায় ইসরাইলের গণহত্যামূলক হামলা ও যুদ্ধ অপরাধ সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথ বন্ধ করে দেয়। রিয়াদ ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ ছাড়া সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে রাজী নয়। শপথ নেয়ার আগে গত মাসে ট্রাম্প বলেন, গাজার যুদ্ধবিরতি চুক্তি গতিতে সঞ্চার করতে আব্রাহাম চুক্তি সম্প্রসারণ করে সৌদি আরবকে তার অন্তর্ভুক্ত করা হবে। চরম ফিলিস্তিনী বিরোধী ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য দূত উইটকিন বলেন, কাতারকেও এর আওতায় আনা হবে। তিন দফায় গাজায় জটিল যুদ্ধবিরতি চলার গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নেতানিয়াহু-ট্রাম্প বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় প্রথম দফায় ৪২ দিনের যুদ্ধবিরতি ও বন্দী বিনিময় চুক্তি কার্যকর শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত চার দফায় অন্তত ২০ জন জিম্মি ও পাঁচ শতাধিক ফিলিস্তিনী যুদ্ধবন্দী মুক্তিলাভ করেছে। শপথ গ্রহণের আগেই নতুন ট্রাম্প প্রশাসন যুদ্ধবিরতি চুক্তির ব্যাপারে আলোচনায় মধ্যস্থতা করে। ট্্রাম্প যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা সম্পন্ন করতে আগ্রহী। চুক্তির প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার পর পুনরায় যুদ্ধ শুরু করার জন্য নেতানিয়াহু তার সরকারের চরম ডানপন্থী ইহুদী দলগুলোর চাপের মধ্যে রয়েছেন। তবে ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনার আগ পর্যন্তু তিনি যুদ্ধবিরতি মেনে চলতে চান বলে মনে হচ্ছে।

চরমপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ অধিকৃত পশ্চিম তীরের ওপর ইসরাইলী দখল ও সার্বভৌমত্ব শক্তিশালী করতে নেতানিয়াহুকে চাপ দিচ্ছেন। গাজায় যুদ্ধ বন্ধ হলেও পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অবিরাম হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে ইসরাইলী বাহিনী। সেখানে অন্তত ২৫ জন ফিলিস্তিনী নিহত ও বহু আহত হয়েছে। গৃহহীন হয়েছেন অন্তত ১৫ হাজার ফিলিস্তিনী। চলতি বছরে পশ্চিম তীরে ইসরাইলী হামলায় অন্তত ৭০ জন ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছে।

ফিলিস্তিনীরা পূর্ব জেরুসালেমকে রাজধানী করে পশ্চিম তীর ও গাজাকে নিয়ে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই পশ্চিম তীরকে গ্রাস করতে আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে সেখানকার ফিলিস্তিনীদের জমিজাতি ও বাড়িঘর ধ্বংস ও দখল করে প্রায় ১৪০টি ইহুদী বসতি গড়ে তুলেছে।

গাজায় নিহতের সংখ্যা ৬১,৭০০ ছাড়াল : গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সেখানে অন্তত ৬১ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনী অসামরিক লোক নিহত হয়েছে। এ ছাড়া ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া ১৪ হাজার ২২২ জন নিখোঁজ রয়েছে। আল-আরাবিয়া আল-জাদিদ এ খবর জানায়, উত্তর গাজার শায়েখ জায়েদ শহর থেকে আরও ২০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে ইসরাইলী হামলায় তারা নিহত হয়। গাজায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল গণহত্যামূলক হামলা চালিয়ে আসছিল। ওই দিন হামাসের অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড অভিযানের পর ইসরাইল গাজা উপত্যকায় হামলা শুরু করে। প্রথমে বিমান হামলা চালায় দখলদার দেশটি। পরে ইসরাইল স্থল হামলাসহ সর্বাত্মক হামলা শুরু করে। আল-আকসা ফ্লাড অভিযানে ১১০০ ইসরাইলী নিহত এবং ২৫১ জন জিম্মি হিসেবে আটক হয়। ভয়াবহ পশ্চিমা অস্ত্রশস্ত্র এবং সর্বাধুনিক সেনাবাহিনীর ভয়াবহ বোমা হামলায় মাত্র ৩৬০ বর্গমাইলের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। উদ্বাস্তুতে পরিণত হয় সেখানকার ২৪ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ১৯ লাখই। মাহমুদ আব্বাসের ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষ পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনীদের জাতিগত নির্মূলের চলমান হামলার নিন্দা করেছে। তারা ইসরাইলী হামলা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।

গাজা খালি করার ট্রাম্পের পরিকল্পনা : গাজার ফিলিস্তিনীদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনা আরব দেশগুলো সম্মিলিতভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ট্রাম্প বলেন, গাজা বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। সাগরতীরবর্তী অঞ্চলটি পরিষ্কার করা দরকার। এ জন্য সেখানকার অন্তত ১৫ লাখ ফিলিস্তিনীকে মিসর ও জর্ডানে সরিয়ে নেয়া দরকার।

মিসর জর্ডান, সৌদি আরব, তুরস্ক, ইরান ও ফিলিস্তিনীরা ট্রাম্পের এমন পরিকল্পনার নিন্দা ও প্রত্যাখ্যান করেছে। ইরান বলেছে, ফিলিস্তিনীদের নয় ইসরাইলে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে আমদানি করা ইহুদীদেরকে ট্রাম্প ইসরাইল থেকে গ্রীনল্যান্ডে নিয়ে গেলে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ট্রাম্প বলেন, গাজা একটি চমৎকার জায়গা। সেখানে পুননির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যাবে। আরবদের টাকায় পুনর্গঠন করে সেখানকার বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে পর্যটন কেন্দ্র বানানোর ট্রাম্পের এ পরিকল্পনা ইসরাইলের গাজার বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করার পরিকল্পনার প্রতিধ্বনি। ইসরাইলের সঙ্গে আলোচনা করে ট্রাম্প এই পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

ট্রাম্প গাজায় ১৫ মাস ধরে চলা ইসরাইলের গণহত্যার শিকার গাজাবাসীর কথা তার এই পরিকল্পনায় কোন আমলে আনেননি। তা ছাড়া এতে যে আন্তর্জাতিক আইন লংঘিত হবে সে বিষয়টির প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ করেননি। তবে ট্রাম্প যা বলেন তা করে থাকেন। তার এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছে রাশিয়া। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গাজাবাসীকে সরিয়ে দেয়ার ট্রাম্পের পরিকল্পনা অগ্রহণযোগ্য ও বেআইনী। ইসরাইল ১৫ মাস ধরে ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়ে গাজার ২৪ লাখ মানুষকে উচ্ছেদ করতে পারেনি। সেখানে ট্রাম্প তার কূটনৈতিক কূটচালে তা করতে পারবে, এমনটি আশা করা যায় না।

(সূত্র : টাইমস অব ইসরাইল, আল-আরাবিয়া আল-জাদীদ আল-জাজিরা )