কলাম
জনগণের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে
জুলাই বিপ্লবের সাড়ে ৬ মাস পর অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের মুখ থেকে পতিত ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারের ধিকৃত শ্লোগান শোনা যাবে, সম্ভবত সেটা বাংলাদেশের কোনো মানুষই আশা করেননি। কিন্তু কখনো কখনো অসম্ভবও সম্ভব হয়ে যায়।
Printed Edition
॥ আসিফ আরসালান ॥
জুলাই বিপ্লবের সাড়ে ৬ মাস পর অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের মুখ থেকে পতিত ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারের ধিকৃত শ্লোগান শোনা যাবে, সম্ভবত সেটা বাংলাদেশের কোনো মানুষই আশা করেননি। কিন্তু কখনো কখনো অসম্ভবও সম্ভব হয়ে যায়। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৬৯ সালে যখন বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয় তখন আওয়ামী লীগের অফিস ছিল পুরানা পল্টনে। সে অফিসে আওয়ামী লীগের কেউ না হয়েও আগ্রহ বশত আমি মাঝে মাঝে সেখানে যেতাম। সেখানে মাঝে মাঝে একটি শ্লোগান শোনা যেত। সেটি হলো, ‘একটা একটা মাউড়া ধর/সকাল বিকাল নাস্তা কর’। বলাবাহুল্য, মাউড়া বলতে তারা অবাঙ্গালী বা বিহারি বোঝাতো। শেখ হাসিনা আমলের শুরু থেকেই জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় চ-াল রূপ ধারণ করে থাকতো। মাঝে মাঝে ছাত্রলীগ, যেটি সাধারণ্যে হেলমেট বাহিনী বা আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে পরিচিত, তারা শ্লোগান দিত, ‘একটা একটা শিবির ধর/সকাল বিকাল নাস্তা কর’। আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের কন্ঠে এ ধরনের বিভৎস শ্লোগানে মানুষ অবাক হয়নি। কারণ তখন অনেক শিক্ষিত সচেতন মানুষ বলতেন, অধিসর খবধমঁব যধং নববহ নড়ৎহ রিঃয ধ নষড়ড়ফু ংঃধৎ ড়হ ঃযব ংশু.
কী আশ্চর্য! সেদিন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং ছাত্রদলের মধ্যে যে সংঘর্ষ হয়ে গেল সেখানে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে ঐ ধরনের ভয়ঙ্কর শ্লোগান শোনা গেল। ছাত্রদল সেদিন শ্লোগান দিয়েছিল, ‘একটা একটা শিবির ধর/ধইরা ধইরা জবাই কর’। ইউটিউবে ড. জাহেদুর রহমান নামক এক ইউটিব ব্লগারের ভিডিও শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। তিনি বলেন যে, ছাত্রদল ঐ শ্লোগানটি দিয়েছে। তিনি বারবার রিপিট করেন, এটি বিভৎস। এটি কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। সেদিন ছাত্রদল যখন কুয়েট বিশ^বিদ্যালয়ে তাদের উস্কানিমূলক তৎপরতা চালাচ্ছিল তখন শিবির নয়, সাধারণ ছাত্রসমাজ তাদেরকে ধাওয়া দেয়। তাদের শ্লোগান ছিল, তাদের বিশ^বিদ্যালয়ে তারা ছাত্র রাজনীতির নামে কোনো রাজনৈতিক দল বা ছাত্রদল চায় না। সাধারণ ছাত্রদের ধাওয়া খেয়ে তারা বেরিয়ে যায় এবং মেইন গেটের অপর পাড়ে তারা অবস্থান নেয়। কিছুক্ষণ পর বিএনপি এবং তাদের ঘরানার লোকজন এসে তাদের সাথে অর্থাৎ ছাত্রদলের সাথে যোগ দেয়। এদের প্রায় সকলেই ছিল বহিরাগত। তাদের অনেকের হাতে ছিল রামদা, কিরিচ প্রভৃতি দেশীয় অস্ত্র। তারা যে দেশীয় অস্ত্র বহন করছিল সেটির ছবি একাধিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। সত্যকে গোপন করতে না পেরে অবশেষে তারা অস্ত্রধারী ঐ যুবককে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছে।
এব্যাপারে পত্রপত্রিকায় যে রিপোর্ট উঠেছে সেটি নি¤œরূপ: খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের সময় ধারালো অস্ত্র হাতে অবস্থান নেয়া এক যুবদল নেতাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কৃত মাহবুবুর রহমান খুলনার দৌলতপুর থানা যুবদলের সহ-সভাপতি।
গত মঙ্গলবার রাতে কেন্দ্রীয় যুবদলের দপ্তর সম্পাদক নুরুল ইসলাম সোহেল স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে দৌলতপুর থানা যুবদলের সহ-সভাপতি মাহবুবুর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কৃত নেতৃবৃন্দের কোন অপকর্মের দায়-দায়িত্ব দল নিবে না।
॥ দুই ॥
এব্যাপারে খুলনা ইসলামী ছাত্রশিবির যে অবস্থান নিয়েছে সেখানে তারই সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। খুলনা ইসলামী ছাত্রশিবির এ ব্যাপারে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সেক্রেটারি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, নিজেদের অপরাধমূলক কার্যকলাপের দায় ছাত্রশিবিরের ওপর চাপিয়ে দেয়ার যে প্রবণতা ছাত্রলীগের ছিল, তা আজ ছাত্রদলের মধ্যেও বিদ্যমান। এ ধরনের আচরণ ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ এবং সুস্থধারার রাজনীতির পরিপন্থী। তাদের এমন অনৈতিক কর্মকা- পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতা ও বন্ধুভাবাপন্ন ছাত্ররাজনীতির পথে অন্তরায়। তারা বলেন, নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ বিগত ১৬ বছর ধরে যে অপরাজনীতির প্রবর্তন করেছিল, ছাত্রদল ঠিক একই পথ অনুসরণ করছে। নিজেদের অপরাধমূলক কার্যকলাপের দায় ছাত্রশিবিরের ওপর চাপিয়ে দেয়ার যে প্রবণতা ছাত্রলীগের ছিল, তা আজ ছাত্রদলের মধ্যেও বিদ্যমান। এ ধরনের আচরণ ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ এবং সুস্থধারার রাজনীতির পরিপন্থী। তাদের এমন অনৈতিক কর্মকা- পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতা ও বন্ধুভাবাপন্ন ছাত্ররাজনীতির পথে অন্তরায়।
বাংলাদেশের মানুষ গভীর পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করছেন যে, ৫ আগস্ট জুলাই বিপ্লবের সফল সমাপ্তির পর জনগণ বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী শক্তি সমূহের মধ্যে যে ঐক্য প্রত্যাশা করেছিলেন সেটি সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ এবং ক্ষমতার রাজনীতির বেদীমূলে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। একথা ঠিক যে, চরম ধিকৃত নাৎসিবাদী স্বৈরাচারের উৎখাত করা হয়েছে জনগণের অধিকার এবং নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। কিন্তু সে মহৎ কার্যটি সুসম্পন্ন করতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দিয়ে প্রতি বিপ্লবীরা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে এবং স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। ফরাসি বিপ্লব সংঘঠিত হয়েছিল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। কিন্তু সেই কাজটি সুসম্পন্ন হওয়ার পূর্বে ফ্রান্সকে ৩টি প্রতি বিপ্লবকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। তারপর যেটির সূচনা হয়েছিল সেটিরই পূর্ণ বিকশিত রূপ হলো আজকের গণতন্ত্রের রোল মডেল ফ্রান্স।
পক্ষান্তরে ঠিক উল্টোটা ঘটেছে মিশরে। মিশরের তিউনিশিয়া থেকে শুরু হওয়া আরব বসন্তের ঢেউ লেগেছিল তাহরির স্কয়ারে। ৮০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেখানে জনগণকে সঠিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য জীবন পণ সংগ্রাম করে যাচ্ছে ইখওয়ানুল মুসলেমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুড। এজন্য ইখওয়ানের অনেক নেতাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছে। বাংলাদেশেও একই মহান উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জামায়াতে ইসলামীর ৫ জন শীর্ষ নেতা নিকৃষ্ট ডিক্টেটর শেখ হাসিনার ফাঁসি কাষ্ঠে জীবন দিয়েছেন। মিশরে ইখওয়ানুল মুসলেমিন জনাব মুরসির নেতৃত্বে ৩২ বছরের স্বৈরাচার হুসনি মোবারককে উৎখাত করে জনগণের রাজত্ব কায়েম করেছিল। কিন্তু মৌলবাদ ফেরি করা বৃহৎ শক্তিটি মিশরে ইসলামী বিপ্লবকে বরদাস্ত করতে পারেনি। তাই তারা সামরিক বাহিনীকে উস্কে দেয়। সেনাপ্রধান জেনারেল সিসি মুরসিকে উৎখাত করেন। আজও মিশরে সেনা শাসন জনগণের ওপর জগদ্দল পাথরের মত চাপিয়ে বসে আছে।
॥ তিন ॥
বাংলাদেশে এতবড় একটি বিপ্লবের পর মাত্র ৬ মাস সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। একমাত্র আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী ঘরানা ছাড়া আর সমস্ত দল একবাক্যে বলছেন যে শেখ হাসিনা রাজনীতি কলুষিত করেছেন, বিচার বিভাগকে ধ্বংস করেছেন, প্রশাসনকে নষ্ট করেছেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করেছেন এবং অর্থনীতিকে রাজতন্ত্রের মহারাণীর মতো লুটপাটের চারণভূমিতে পরিণত করেছিলেন। তারা সকলেই বলছেন যে বাংলাদেশের মতো বিপ্লব তারা বিগত ১০০ বছরেও পৃথিবীর কোথাও দেখেননি। সম্ভবত সেকারণেই বাংলাদেশের বিপ্লবকে অনেক বিদেশী মনসুন রেভ্যুলুশন বা বর্ষা বিপ্লব বলছেন। কেউ বলছেন, কালারড বিপ্লব।
লক্ষ লক্ষ নয়, কোটি মানুষ এ বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন। এ ধরনের বিপ্লবের পর রাজনীতি সাধারণত কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। কিন্তু ড. ইউনূসের সরকার কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেননি। যার যা মনে হচ্ছে তিনি তাই বলছেন এবং যার যা মনে হচ্ছে তিনি তাই লিখছেন। আজ আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। তাই বিএনপি যদি মনে করে যে আগামী দিনের ক্ষমতার মসনদ হবে তাদেরই তাহলেও কারো কিছু বলার নেই। তারা যদি মনে করে যে, যেহেতু আওয়ামী লীগ ময়দানে নেই তাই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল জামায়াতে ইসলামী তাদের ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি তাহলেও কারোর বলার কিছু নেই। কিন্তু তাই বলে তারা যে এখন প্রধান বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ভাষায় কথা বলবে সেটি কেউ কোনো দিন কল্পনাও করেননি। অথচ তাই আজ ঘটছে।
গভীর পরিতাপের বিষয় যে, বিএনপি ঘরানা নিছক রাজনৈতিক বিরোধিতা করতে গিয়ে বিএনপি জামায়াত এবং শিবিরকে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি বলছে। ৭২ এর শেখ মুজিবের সংবিধানকে রক্তের অক্ষরে লেখা সংবিধান বলছে। এ ব্যাপারটি প্রশংসার দাবিদার যে জামায়াত আওয়ামী লীগের ভাষায় পাল্টা আঘাত করছে না। তারা ইতিবাচক রাজনীতি করে যাচ্ছে। এমনকি যেখানে জামায়াতের প্রাক্তন অস্থায়ী সেক্রেটারি এ টি এম আজহারুল ইসলামের মুক্তির দাবি করে গতানুগতিক রাজনীতিতে রাজপথ কাঁপানোর কথা। সেখানে আমীরে জামায়াত ড. শফিকুর রহমান আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি স্বেচ্ছায় কারাবরণের ঘোষণা দিয়েছেন।
এমনই জামায়াত ও শিবিরের রাজনীতি। তবে বিবেকের কন্ঠস্বর হিসেবে এখানে দুই/একটি কথা দরকার। শিবিরের স্বাধীনতা বিরোধী হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ তখন শিবিরের কোনো নেতা বা সদস্যের জন্মই হয়নি। আমীরে জামায়াত স্বয়ং ৭১/৭২ সালে জামায়াত করতেন না। জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বের প্রায় সকলেই একাত্তরে নাবালক ছিলেন অথবা কারো কারো জন্মই হয়নি। বিএনপির বিলক্ষণ জানা উচিৎ যে, পাকিস্তান কোনো সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী পক্ষ হতে পারে না। দেড় হাজার মাইল দূর থেকে এসে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করতে পারে না।
স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি যদি কেউ হতে পারে তাহলে সেটি ভারত। শেখ মুজিবের সময় তারা মুজিবকে দিয়ে ২৫ বছরের গোলামীর চুক্তি স্বাক্ষর করিয়েছিল। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে তারা বাংলাদেশকে একটি করদ রাজ্যে পরিণত করেছিল। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী হতে পারে ভারত এবং ভারতের পদলেহী আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী ঘরানা।
বিএনপি সম্পর্কে আমরা সরাসরি কোনো মন্তব্য এখনও করছি না। তবে শেষ করার আগে জুলাই বিপ্লবের অন্যতম দুঃসাহসী নায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহর ভেরিফায়েড ফেসবুকে প্রদত্ত একটি উক্তি দিয়ে শেষ করছি। তিনি লিখেছেন, “যারা আগে আন্দোলনের ডাক দিয়ে মাঠ থেকে সরে যেতো, তারাই এখন আঁতাতের রাজনীতি, ভারতনির্ভর কূটনীতির মাধ্যমে আওয়ামী পুনর্বাসন চাচ্ছে। দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় কার সাথে কে ব্যবসা করেছে, আর গ্রেফতারের পর কে কার জন্য তদবির করেছে এ খবর আমাদের কাছে আছে।”
আজকে এখানেই শেষ করছি। মনে হচ্ছে বিএনপির সাথে অন্যদের মত বিরোধ চলবেই। তবে সেটি কতখানি তীব্র থেকে তীব্রতর হবে সেটি সময়ই বলবে।