DailySangram-Logo

কলাম

পশ্চিম তীরে ইসরাইলী হামলার উদ্দেশ্য কী

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলী বর্বরতায় ৪৭ হাজার প্রাণ ঝরে যাওয়ার পর রণে ভঙ্গ দিয়েছে তেল আবিব। গাজা এখন ধ্বংস্তূপ ছাড়া কিছু নয়।

Printed Edition

॥ আহমদ মতিউর রহমান ॥

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলী বর্বরতায় ৪৭ হাজার প্রাণ ঝরে যাওয়ার পর রণে ভঙ্গ দিয়েছে তেল আবিব। গাজা এখন ধ্বংস্তূপ ছাড়া কিছু নয়। গাজা পুনর্গঠন ও আহত বাস্তুচ্যুত মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেয়া, তাদের প্রাণে বাঁচার অধিকারটুকু ফিরিয়ে দেয়া এখন সময়ের দাবি। এ লক্ষ্যে ব্যাপক ত্রাণ সহায়তা দরকার। কিন্তু এমন মুহূর্তে পরাস্ত ইসরাইল নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। তারা এখন ফিলিস্তিনের মূল এলাকা পশ্চিম তীরে হামলা শুরু করেছে। এ পর্যন্ত কয়েক শত লোককে হত্যা করেছে। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, হতোদ্যম হয়ে পড়া ইসরাইলী সেনাদের চাঙ্গা রাখতেই নতুন যুদ্ধ খেলায় লিপ্ত হচ্ছে ইসরাইল। আর ইহুদী রাষ্ট্রটির একনিষ্ঠ সেবক আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নতুন বক্তব্য হাজির করেছেন। তিনি বলেছেন, গাজার দখল নেবে যুক্তরাষ্ট্র, সরানো হবে ফিলিস্তিনীদের। সংবাদ মাধ্যমের খবর হলো, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, দেশটি যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা দখল করে নেবে এবং এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাজ করবে। তবে তার আগে সেখানকার ফিলিস্তিনী বাসিন্দাদের ‘অন্য কোথাও’ সরিয়ে নেওয়া হবে। বুধবার এ তথ্য জানিয়েছে রয়টার্স। ওয়াশিংটন সফররত ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে এক যৌথ সম্মেলনে এ বিস্ময়কর পরিকল্পনার কথা জানান ট্রাম্প। যা বিশ্বের বিবেকবান ও শান্তিপ্রিয় মানুষকে বিস্মিত করেছে।

বিশ্লেষকরা এমন এই কথাকে অনাকাক্সিক্ষ বলছেন। তারা বলেন, এভাবে গাজা দখল করে দীর্ঘসময় সে দখল ধরে রাখার এখতিয়ার আছে কী না যুক্তরাষ্ট্রের? তাকেও এ প্রশ্ন করা হয়েছিল। এ প্রশ্নেরও সরাসরি জবাব দেননি তিনি। তবে বিশ্লেষকদের ধারণা, ট্রাম্পের এই বক্তব্যে বেশ কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইল-ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে যে নীতিমালা ও দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে এসেছে, তা ধসে পড়েছে।

ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীরে ২ ফেব্রুয়ারি ব্যাপক হামলা চালিয়েছে ইসরাইলী বাহিনী। এতে অন্তত ২৩টি বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। পশ্চিম তীর একটি ভূবেষ্টিত অঞ্চল এবং ফিলিস্তিন রাজ্যের পূর্ব অংশ; মধ্যপ্রাচ্যের জর্ডানের নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধের সময় ইসরাইল এটি দখল করে নেয়। পরে এটি ফিলিস্তিনের অংশ হয়। এখনো বহুলাংশ ইসরাইলের শাসনাধীন। সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানিয়েছে, ২ ফেব্রুয়ারি অধিকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন শরণার্থী শিবিরে দফায় দফায় বিমান হামলা চালায় ইসরাইলী বাহিনীর। হামলায় বেশ কয়েকটি বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। বিস্ফোরণ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, এর শব্দ শোনা গেছে আশপাশের শহরগুলো থেকেও। জেনিন শরণার্থী শিবিরের কাছের আদ-দামজ এলাকার একটি আবাসিক ব্লক উড়ে গেছে বলে জানায় আল জাজিরা। এক বিবৃতিতে ইসরাইলের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, জেনিনে কয়েকটি ভবন ধ্বংস করা হয়েছে। এ ভবনগুলো সন্ত্রাসী অবকাঠামো হিসেবে ব্যবহার হচ্ছিল। তবে এর কোনো প্রমাণ দেয়নি ইসরাইলী বাহিনী। ইসরাইলের সেনাবাহিনী গত মাস থেকে পশ্চিম তীরে অভিযান শুরু করেছে। এ অভিযানের নাম দেয়া হয়েছে আয়রন ওয়াল। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে পশ্চিম তীরে ইসরাইলের হামলায় ৫০ ফিলিস্তিনী যোদ্ধা নিহত হয়েছে।

ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম বিদেশী সরকারপ্রধান হিসেবে হোয়াইট হাউস গেছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নেতানিয়াহু। গাজায় যুদ্ধ বিরতির প্রথম ধাপ এখন চলছে। এদিকে যুদ্ধবিরতি নিয়ে টেলিফোনে কথা হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি। দু’নেতা গাজা যুদ্ধবিরতি জোরদারের বিষয়ে একমত হন বলে নিশ্চিত করেছে মিশরের প্রেসিডেন্টের দফতর। গাজা থেকে জিম্মিদের মুক্ত করতে মিশরের ভূমিকার গুরুত্ব নিয়ে দুই নেতা কথা বলেন বলে জানায় হোয়াইট হাউস। ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফেরাতে পারবেন বলে নিজের আত্মবিশ্বাসের কথাও জানান সিসি। ফিলিস্তিনীদের না সরিয়েই উপত্যকাটি পুনর্গঠনে কাজ করতে চায় মিশর বলে জানান দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এরমধ্যেই হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা মোহাম্মদ দারবিশ এবং অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান। গাজার যুদ্ধবিরতি ও মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন তারা। ফিলিস্তিনীদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির বিরোধিতা পুনর্ব্যক্ত এবং আহতদের চিকিৎসা ও মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দীদের আশ্রয় দেয়ার প্রস্তুতির কথা জানায় তুরস্ক।

বন্দী বিনিময় নিয়ে যা জানা যাচ্ছে : যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতাকারী অন্যতম দেশ মিসর জানিয়েছিল, যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় প্রথম ছয় সপ্তাহে মোট ১,৮৯০ জন ফিলিস্তিনী মুক্তি পাবে। চুক্তির আওতায় ইসরাইলী বিচার বিষয়ক মন্ত্রণালয় ৭৩৪ জন বন্দী ও আটক ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করে। যাদেরকে মুক্তি দেয়া হবে বলেও জানিয়েছি ইসরাইল। তবে ওই ৭৩৪ জন কি ওই ১৮৯০ জনের তালিকার মধ্যে রয়েছে কী না সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে যে ওই ১৮৯০ জনের মধ্যে থেকেই ৭৩৪ জনের তালিকা প্রকাশ করেছে ইসরাইল। ৭৩৪ জনের বাইরে ইসরাইল বাকি ১ হাজার ১৫৬ জন বন্দীর বিষয়ে এখনো কিছু জানায়নি। যুদ্ধবিরতি চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল বন্দী বিনিময়। তবে প্রতি দফায় কতজন জিম্মি কোন দেশ মুক্তি দিবে সেটি এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে হামাস দাবি করছে যে, যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী প্রতি একজন ইসরাইলী বন্দীর মুক্তির জন্য ৩০ জন ফিলিস্তিনী বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হবে।

ফিলিস্তিনের গাজায় দীর্ঘ ১৫ মাস পর যুদ্ধবিরতি চুক্তির মধ্য দিয়ে থামে ইসরাইলের নৃশংসতা। বন্ধ হয় নির্বিচার হামলা। আসতে শুরু করে ত্রাণ। উপত্যকাটির বাসিন্দাদের মধ্যে আসে কিছুটা স্বস্তির ছোঁয়া। ইসরাইলীদের মধ্যেও আনন্দের রেশটা কম নয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তারা মিলিত হতে যাচ্ছেন গাজায় হামাসের হাতে বন্দী থাকা জিম্মিদের সঙ্গে।

যুদ্ধ বিরতির কী হাল? ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি শুরু হয়। এরপর গাজাবাসী আনন্দ উদযাপন শুরু করতে দেরি করেননি। আতশবাজি পোড়ানো ও পটকা ফোটানোর শব্দ শোনা যায়। গাজায় নিজ নিজ এলাকায় ফেরা শুরু করেন লোকজন। গাজায় যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার মধ্য দিয়ে। ওই হামলায় ১ হাজার ২০০ জনের বেশি ইসরাইলী নিহত হন। জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয় প্রায় আড়াই শ জনকে। এখনো হামাসের হাতে জীবিত বা মৃত প্রায় ৯০ জন জিম্মি রয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।

চুক্তি অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে মুক্তি পেতে যাওয়া ৩৩ জন জিম্মির নামের তালিকা ইসরাইলকে দিয়েছে হামাস। প্রথম তিনজনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের বরণ করে নিতে তেল আবিবে ইসরাইলীদের জড়ো হতে দেখা যায়। এসব জিম্মিদের মুক্ত করতে ১৫ মাস ধরে আন্দোলন করেছেন তারা। পরে আরো ৪ জন জিম্মি মুক্তি লাভ করেন। এদের বিনিময়ে দু’দফায় ৪৯০ জন ফিলিস্তিনী বন্দী মুক্তি পেয়েছেন। এমন ইতিবাচক তৎপরতা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর বৈঠকে নতুন কোন এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা হলে এই প্রক্রিয়া হোঁচট খেতে পারে।

এসব খবরের মধ্যেই পশ্চিম তীরে হামলা জোরদার করেছে ইসরাইল। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম তীরের জেনিন এলাকায় ইসরাইলী সামরিক বাহিনীর পৃথক হামলায় এক কিশোরসহ পাঁচজন ফিলিস্তিনী নিহত এবং আরো দু’জন গুরুতর আহত হয়েছেন। ফিলিস্তিনের রামাল্লা থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানায়। ইসরাইল এই সামরিক অভিযানকে ‘আয়রন ওয়াল’ নামে অভিহিত করেছে, যা গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু হয়। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রথম ইসরাইলী বিমান হামলায় জেনিনের পূর্বাঞ্চলের একটি এলাকায় ১৬ বছর বয়সী আহমেদ আল-সাদি নিহত এবং আরো দু’জন গুরুতর আহত হয়েছেন। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পশ্চিম তীরে ইসরাইলী সেনা বা বসতি স্থাপনকারীরা কমপক্ষে ৮৮১ জন ফিলিস্তিনীকে হত্যা করেছে, যার মধ্যে অনেক জঙ্গীও রয়েছে। ইসরাইলী সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, একই সময়ে ফিলিস্তিনীদের হামলা বা ইসরাইলী সামরিক অভিযানে কমপক্ষে ৩০ জন ইসরাইলী নিহত হয়েছেন।

বিশ্লেষকরা বলেছেন গাজায় হামলা বন্ধ করে ইসরাইল পশ্চিম তীরে হামলা জোরদার করে আসলে কোন লক্ষ্য হাসিল করতে পারবে না। এটা করা হলে ৯০ জন জিম্মির বন্দী দশা শেষ হবে না। ট্রাম্পের কথার বা পশ্চিম তীরে হামলার ব্যাপারে হামাস এখনো কোন বক্তব্য দেয়নি। ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষ হামলার নিন্দা জানিয়েই যাচ্ছে। কী হতে যাচ্ছে কিছু দিনের মধ্যেই স্পষ্ট হবে। তবে যুদ্ধবিরতি থেকে বের হওয়ার কোন ছুতা খোঁজা ইসরাইলের জন্য শুভকর হবে না বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।