DailySangram-Logo-en-H90

কলাম

দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রাক প্রস্তুতি

প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম দুর্যোগ আমাদের কর্মের বহিঃপ্রকাশ। আমরা নিজেরাই দুর্যোগের সৃষ্টি করি এবং দুর্যোগ নেমে আসার যাবতীয় প্রক্রিয়া তৈরি করি। পাহাড় ধস, খরা, বন্যা, নদী ভাঙন, রোগ-বালাই, মহামারি, ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, বজ্রপাত, কালবৈশাখী ঝড়, জলোচ্ছাস, ভূমিকম্প, সুনামি, তুষারঝড় এগুলো হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

Printed Edition

॥ কাজী খোরশেদ আলম ॥

প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম দুর্যোগ আমাদের কর্মের বহিঃপ্রকাশ। আমরা নিজেরাই দুর্যোগের সৃষ্টি করি এবং দুর্যোগ নেমে আসার যাবতীয় প্রক্রিয়া তৈরি করি। পাহাড় ধস, খরা, বন্যা, নদী ভাঙন, রোগ-বালাই, মহামারি, ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, বজ্রপাত, কালবৈশাখী ঝড়, জলোচ্ছাস, ভূমিকম্প, সুনামি, তুষারঝড় এগুলো হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তাছাড়া কিছু দুর্যোগ রয়েছে যা মানুষ তাদের নিজের স্বার্থসিদ্ধি হাসিল করার জন্য সৃষ্টি করে থাকে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো এক প্রকারের প্রাকৃতিক ঘটনা-যা মানুষের আর্থ-সামাজিক ক্ষতি হয়ে থাকে। যদিও তা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবেই ঘটে থাকে, তবে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের কাজ-কর্মের প্রভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম কোন ঘটনা। যুগ যুগ ধরে মানুষের কার্যকলাপের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে আসছে।

তবে কোন কোন সময় মানুষ বিভিন্ন অপরাধের জগত সৃষ্টির মাধ্যমে দুর্যোগের আগমন ঘটায়। যেমন কালোবাজারিরা অধিক মুনাফার লোভে পন্য মজুদ করে বাজারের স্বাভাবিক মূল্যকে অগ্নিমূল্যে রূপান্তরিত করে দুর্যোগের সৃষ্টি করে থাকে। এছাড়া এক শ্রেণীর অসাধূ ব্যবসায়ীরা তাদের নিজেদের টাকার পাহাড় গড়ে তোলার জন্য মাদককে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে দিয়ে মানবিক দুর্যোগের সৃষ্টি করে রেখেছে। যুবসমাজ আজ মাদকের কড়াল গ্রাসে পতিত হয়ে আছে। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তবু মাদক নির্মূল হচ্ছে না। দেশের এমন কোন জায়গা নেই; যেখানে মাদকের ছোঁয়া নেই।

বর্তমানে মাদক সমাজ ও দেশ এবং মানব সম্প্রদায়ের জন্য দুর্যোগ হিসেবে আর্বিভাব হয়েছে। মাদকাসক্ত সন্তানের বাবা-মা বলতে পারবে, মাদক কত জঘন্যতম দুর্যোগ। মাদককে কেউ দুর্যোগ বলুক আর না বলুক: আমি বলব পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্যোগ হলো মাদকাসক্ত এলাকা। যেখানে নেই কোন সামাজিক মূল্যবোধ; নেই কোন নিয়ম-নীতি, ধর্ম-কর্মের বালাই। আইন কানুন কী জিনিস তা বুঝার মতো জ্ঞানশক্তি ও বোধশক্তি নেই। মাদকের ছোবলে সর্বস্বান্ত হয়ে একদিন ভিখারীর মতো কত ধনীর দুলালের ইহকাল সাঙ্গ হয়। নেশাগ্রস্থ ব্যক্তি যে কোন অপরাধ করতে দ্বিধাবোধ করে না। কারণ ভালো-মন্দ বিচার করার মতো বিবেক তার অবশিষ্ট থাকে না। মানবতাবোধ চিরকালের জন্য তার হৃদয় থেকে বিদায় নেয়-সাথে তার সুন্দর জীবনটা ল--ভ- করে দেয়; মাদকাসক্ত ও নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি নিজেকে নিঃশেষ করার সাথে সাথে তাদের নিজেদের পরিবার-পরিজন, স্ত্রী-পুত্র, সন্তানকে অনাকাক্সিক্ষত ভবিষ্যৎতের দরজায় দাঁড় করিয়ে যায়। মাদক নামক দুর্যোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু বক্তব্য আর ক্রসফায়ার দিতে কিছু মাদক ব্যবসায়ী হত্যা করলে বন্ধ হবে না। কারণ মানুষ স্বভাবগতভাবে এমন: যাতে নিষেধ আছে, যা করতে মানা-তার প্রতি আকর্ষণ বেশি থাকে। এটা আমাদের জন্মগত অভ্যাস। তাই প্রত্যেক পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মাদকের খারাপ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করে জনসচেতনা বৃদ্ধি করতে হবে। যুবসমাজকে পরিবারিক ও সামজিক মূল্যবোধের দিকে ধাবিত করতে হবে; যেন তারা নিজেরাই মাদক সেবন না করে মাদকের কূফল নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করতে উৎসাহিত হয়। এজন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। কিন্ত আমাদের কার্যক্রম এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখতে পাওয়া যায়।

দুর্যোগ আসার পূর্বে কোন রকম প্রস্তুতি বা পদক্ষেপ থাকে না। বড় ধরনে দুর্ঘটনা ঘটার পরে অথবা দুর্যোগের কবলে পতিত হওয়ার পর সর্বশক্তি প্রয়োগ করে কোমড় বেঁধে দুর্যোগ মোকাবেলার চেষ্টা করি। যখন নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়-তখন আমরা নিয়তির উপর ছেড়ে দেই বা সৃষ্টিকর্তার দোহাই দেই। এভাবেই চলছে। ধরুন কিছুদিন পূর্বে সারা দেশে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়েছে-যে ছেলে-মেয়েদের কল্লা কেটে নেওয়া হয়। স্কুলগামী ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের অভিভাবকরা ভয়ে তাদের আদরের সন্তানদেরকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। আবার কেউ কেউ সন্তানদের নিজের সাথে করে স্কুলে আসা-যাওয়া করে। এভাবে কয়েক দিন চলার পর কল্লা কাটা সন্দেহে-দেশের বিভিন্ন জায়গায় গণ-পিটুনিতে কয়েক জন মারা যায়। তারপর দেশের কর্তাব্যক্তিদের ঘুম ভাঙে। প্রত্যেক থানা এবং উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল-কলেজে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাঠে নামে-“গুজবে কান দিবেন না” শ্লোগান নিয়ে। এ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও লিফলেট বিতরণ শুরু হয়। কাউকে সন্দেহ হলে পুলিশে সোর্পদ করার জন্য মানুষকে উৎসাহিত করেন। আইন যেন কেউ নিজের হাতে তুলে না নেয়-সেই বিষয়ে জোরালো কার্যক্রম শুরু করে। কিন্ত এ কার্যক্রমগুলো যদি গুজব রটনার সাথে সাথে নেওয়া হতো-তাহলে এতো গুলো নিরীহ মানুষের প্রাণ অকারণে ঝরে যেত না। নিরীহ মানুষগুলো নিজেরাই জানতে পারল না-কেন তাদেরকে শিয়াল কুকুরের মতো পিটিয়ে হত্যা করা হলো। গুজবের ফলে বিনা কারণে যাদের প্রাণ গেল-এই দায় কার?

দেশের বিভিন্ন জেলার মধ্যে যখন বন্যা পানি ঢেউ খেলছে এবং মানুষের ঘর-বাড়ী ডুবে গিয়ে আশ্রয়স্থল হারিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছে এবং অপর দিকে কল্লা কাটার গুজবে ছেলে-মেয়ের অভিভাবকরা আংতকে উৎকন্ঠায় দিন পার করছে-এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি জেলায় নেমে আসল ডেঙ্গুজ¦র নামের আরেক বড় ধরনের দুর্যোগ। ডেঙ্গু থামাতে গিয়ে দুই সিটি মেয়রের অবস্থা কাহিল। দিন-রাত বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরেও সমালোচনা তাদের পিছু ছাড়ে না। তারা প্রায় ব্যর্থ হওয়ার পথে গিয়ে ঠেকেছেন। ডেঙ্গুজ¦রে আক্রান্তের সংখ্যা যখন বাড়তে লাগল তখন সারা দেশের মানুষের মধ্যে চেতনা ফিরে আসল। তখন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের আনাচে কানাচের ঝোঁপ-জঙ্গল, পানি জমে থাকার মতো বিভিন্ন পাত্র পরিষ্কারর করার কাজে সবাই নেমে যায়। গ্রাম-গঞ্জের স্কুল, কলেজ, মাদরাসার শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে পরিষ্কার পরিছন্নতা অভিযান শুরু করে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা ডেঙ্গু প্রতিরোধ এবং কল্লা কাটার গুজব থেকে পরিত্রানের উপায় নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয় এবং মাঠ পর্যায়ে জনসচেতনতামূলক সভা-সমাবেশ করতে থাকে।

ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিষ্কার পরিছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। আমরা যে যেই ধর্মের অনুসারী হই না কেন-যদি ধর্মের বিধান মতে কার্যক্রম পরিচালন অব্যাহত থাকত; তাহলে আজকে ডেঙ্গু জ¦র দুর্যোগ আকারে আমাদের মধ্যে আর্বিভাব হতো না। প্রত্যেকেই নিজের থেকে তাদের বসত বাড়ি ও বাসা-বাড়ির আঙিনা নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার পরিছন্ন রাখলে কোথাও ময়ল-আর্বজনা জমতো না। ময়লা-আবর্জনা না থাকলে ডেঙ্গু জ¦রবাহী মশার জন্ম হতো না। তাহলে আজ সকলকে লেংটি ফেলে ডেঙ্গু প্রতিরোধে দৌড়ানোর প্রয়োজন হতো না। তাই আমাদেরর প্রত্যেকের দায়িত্ব যে কোন দুর্যোগ সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে তা প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং জনসচেতনা বৃদ্ধি করা।

লেখক : সভাপতি, বুড়িচং প্রেস ক্লাব।