কলাম
সুস্থধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতির আবশ্যকতা
বাংলাদেশ আয়তনে পৃথিবীর নব্বইতম দেশ। জনসংখ্যার দিক থেকে অষ্টম বৃহত্তম। মুসলমান জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম দেশ। দেশটা আমাদের চির সবুজ, স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। পূর্বে পাহাড়-পর্বত ঘেরা উঁচু নিচু জনপদ। পশ্চিমে দোআঁশ ও বেলে মাটি মিশ্রিত সমতল মাঠ-প্রান্তর। উত্তরে মাঝারি পাহাড়সহ বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল এবং দক্ষিণে ছোট-বড় শত নদ-নদীর পলি বাহিত সমুদ্র মোহনা। প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের মধ্যে কয়লা, লোহা, গ্যাস, ইউরেনিয়াম, মৎস্য, বনজ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
Printed Edition
॥ এইচ এম জোবায়ের ॥
বাংলাদেশ আয়তনে পৃথিবীর নব্বইতম দেশ। জনসংখ্যার দিক থেকে অষ্টম বৃহত্তম। মুসলমান জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম দেশ। দেশটা আমাদের চির সবুজ, স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। পূর্বে পাহাড়-পর্বত ঘেরা উঁচু নিচু জনপদ। পশ্চিমে দোআঁশ ও বেলে মাটি মিশ্রিত সমতল মাঠ-প্রান্তর। উত্তরে মাঝারি পাহাড়সহ বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল এবং দক্ষিণে ছোট-বড় শত নদ-নদীর পলি বাহিত সমুদ্র মোহনা। প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের মধ্যে কয়লা, লোহা, গ্যাস, ইউরেনিয়াম, মৎস্য, বনজ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ২ কোটি ১ লাখ ৫৭ হাজার একর বা ৮০ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। এসব ফসলি জমিতে যে পরিমাণ ধান, পাট, গম, ভূট্টা ও কালাই উৎপাদন হয় তাতে আঠারো কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে বিপুল পরিমাণ রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। হাজারো খাল-বিল, নদ-নদী ও হাওড়-বাওড় এবং সাগর-মহাসাগর থেকে যে পরিমাণ মৎস্য সম্পদ আহরণের সুযোগ আছে তা দিয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পর কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা জাতীয় অর্থনীনিতে যুক্ত করা সম্ভব।
উত্তর-পূর্বের বিশাল টিলা ভূমিতে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস এবং মহামূল্যবান ইউরেনিয়াম মওজুদ আছে তা যদি নিজস্ব সঠিক ব্যবস্থাপনায় উত্তোলন করা যায় তবে এ সবুজের দেশকে বিশ্বের উন্নত দেশসমূহের কাতারে দাঁড় করানো সময়ের ব্যাপার মাত্র। হাজারো গার্মেন্টস, মিল-কারখানা- যা দেশের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে নিজস্ব শিল্পকে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে পারতো। তবে কোনটি পারেনি সবই পারতো! ফলে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ, জলজ, বনজ এবং পর্যাপ্ত মানবসম্পদ থাকার পরও দেশটি শুধু- সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব এবং সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না। ফলে আঠারো কোটি মানুষের ছত্রিশ কোটি হাত আজ দেশের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারছে না! অনাহারে-অর্ধাহারে দিন-রাত কাটায় অসংখ্য মানুষ। দারিদ্র্যের প্রান্ত সীমা ও নিচে বাস করে কোটি বনি আদম। রাজধানীর ব্যস্ত রাস্তাগুলির পাশের ফুটপাতে শত-সহস্র মানুষ রাতের খাবার না খেয়েই ঘুমিয়ে যায়! দেশ যদি আল্লাহভীরু এবং দক্ষ নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত হতো তবে এ অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটতো। স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছর পরও এদেশে কোন গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি।
রাজনীতি বিশ্লেষণে আধুনিককালে যেসব পদ্ধতির দারস্থ হতে হয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি এসবের অন্যতম। রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিপূর্ণ চিত্র ফুটে ওঠে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি বুঝতে হলে এর বিপরীত ফেনোমেনা বুঝতে হবে। সুস্থ রাজনীতি চর্চার অন্তরায় হলো-কপটতা, হিংসা-বিদ্বেষ, অনাস্থা, বৈধতার সংকট, স্বার্থপরতা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, লেজুড়বৃত্তি, স্বৈরাচারী মনেবৃত্তি, পরিবারতন্ত্র, ব্যবসায়ীকরণ, অতিরিক্ত লেজুড়বৃত্তি এবং পেশীশক্তির মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ। একই সাথে-সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের দুর্বলতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পদসোপান অগ্রাহ্য এবং রাজনীতিকিকরণ হচ্ছে অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র বিগত চুয়ান্ন বছর যাবৎ রাজনীতিকীকরণ ও দলীয়করণের আবর্তে ঘূর্ণায়মান। বাংলাদেশের এ ভঙ্গুর রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য কোন দল বা গোষ্ঠীকে এককভাবে দায়ী করা যাবে না। স্বাধীনতা উত্তর ক্ষমতাসীন সকল রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বই এর জন্য দায়ী। পাশাপাশি এখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি হাজার বছরের বহমান বাংলাদেশের যথার্থ প্রতিচ্ছবি। দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে যার সৃষ্টি। তবে রাজনীতিতে যখন উচ্চ শিক্ষা, দক্ষতা এবং প্রায়োগিক জ্ঞানের প্রয়োগ বৃদ্ধি পাবে তখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নত হবে। আমেরিকার বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Lucian Pye এর মতে, Political culture as the composite of basic values, feelings and knowledge that underlie the political process. অর্থাৎ তিনি রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে-মৌলিক মূল্যবোধ, অনুভূতি এবং জ্ঞানের সংমিশ্রণ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন যা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অন্তর্গত। রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো সরকার গঠনের প্রতি নাগরিকদের বিশ্বাস, মতামত এবং আবেগ।
David Paul এর মতে, “রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে মূল্যবোধ, প্রতীক, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণের পর্যবেক্ষণযোগ্য এক বহিরাকৃতি স্বরূপ, যাকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবলোকন করলে মনোভাবগত উপাত্ত অপেক্ষা অধিক পরিমাণে সমাজের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর আলোকরশ্মি বিকিরণ করতে সক্ষম।” Verba ও Almond বলেন, “রাজনৈতিক সংস্কৃতি কথাটি দ্বারা সুনির্দিষ্টভাবে কতিপয় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝায় যার দ্বারা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি নিজের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয়।” ডেনিস কাভান বলেন, “রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো রাজনৈতিক বিষয়াদির প্রতি নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গির এক সামগ্রিক বন্টন ব্যবস্থা।” সুস্থ ও গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির কিছু বাস্তব বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করি; এ সংস্কৃতি রাজনীতিবিদ ও নাগরিকদের মাঝে এক উন্নত চারিত্রিক গুণাবলি এবং ব্যক্তিত্বের জন্ম দেয়। নির্বাচিত হওয়ার জন্য রাজনীতিবিদ পজেটিভ ওয়েতে নির্বাচক মন্ডলীর মন জয় করার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। আর নির্বাচক মন্ডলীও প্রতিনিধি নির্বাচনে জাতীয় স্বার্থ, বিদেশ নীতি, নাগরিকের জীবনমান উন্নতকরণ ইত্যাদি খেয়াল করে প্রার্থী সিলেকশন, অতঃপর নির্বাচিত করবেন। জনপ্রতিনিধিদের উপর যৌক্তিক কারণে নাগরিকগণ অসন্তুষ্ট হলে বা তার বিরুদ্ধে কোন গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হলে তিনি চূড়ান্ত বিচারের অপেক্ষা না করে ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে দ্রুত পদত্যাগ করবেন। বিরোধী দল চুন থেকে পান খসলেই-বিক্ষোভ, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাট-দখল ইত্যাদি করবেন না। সরকারও বিরোধী মত-পথ দমনে অসাংবিধানিক এবং চূড়ান্ত বল প্রয়োগের পথে হাঁটবেন না। দেশ গঠন এবং উন্নয়নে সরকার ও বিরোধী দল স্বীয় অবস্থান থেকে যথার্থ ভূমিকা পালন করবেন। সাংবিধানিক জটিলতা বা জাতীয় যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গণভোটকে ওয়েলকাম জানানো হবে। নির্ধারিত মেয়াদ শেষে পুনরায় জনগণের উপর প্রতিনিধি নির্বাচনের ভার অর্পণ করতে হবে। নির্বাচনকে প্রভাবিত করার কোন ছলা-কলার আশ্রয় নেওয়া যাবে না। ফলাফল যাই হোক তা মেনে নেওয়ার মানসিকতা পোষণ করতে হবে।
এসব নীতিকথা কিতাবী হলেও বাস্তব রাজনীতির মাঠে প্রয়োগ নেই বললেই চলে। কুটিল এবং অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা বের হতে পারেন না। এরও কিছু কারণ রয়েছে। আমাদের রাজনীতিবিদদের বুঝতে হলে তাদের অতীতে ফিরে যেতে হবে। ছাত্র সংগঠনগুলো নব্বই দশকের পর থেকেই স্বকীয়তা হারিয়েছে। ছাত্র রাজনীতিতে মেধাবী মুখে আসছে না বা তাদের স্পেস দেওয়া হচ্ছে না। গোঁয়ার, সন্ত্রাসী মার্কা, আদু ভাই, এবং অস্ত্রবাজ-অছাত্ররা নেতৃত্বের আসন কলঙ্কিত করে আছে! মূল দলের নেতারাও আধিপত্য বিস্তার করতে এমন অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদেরই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। মেধাহীন দখলবাজ, অস্ত্রবাজরাই এখন বিভিন্ন দলের মাঝারি পর্যায়ে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দেশ ও দশের মঙ্গল চিন্তা তাদের মাথায়ই নেই। পদ-পদবি দখল, প্রতিপক্ষকে পেশীশক্তির মাধ্যমে ঘায়েল এবং অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলাই তাদের রাজনীতির একমাত্র উদ্দেশ্য। পাশাপাশি এহেন কদাকার পরিবেশের কারণে কোন মেধাবী মুখ বা সম্ভ্রান্ত ঘরের কোন সন্তান রাজনীতিতে আসার সুযোগ পায় না। এসবের অনিবার্য কারণেই কলুষিত অপরাজনীতির হিংস্র ছোবল থেকে আমরা বের হতে পারছি না। এ ব্যাপারে প্রাজ্ঞ এবং নীতি নির্ধারণী মহল যদি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন তবে বাংলাদেশের ভবিষ্যত একেবারেই অনিশ্চিত। উপনিবেশবাদের কবল থেকে বিশ্ব মুক্ত হলেও নব্য উপনিবেশবাদের রাহু থেকে যেমন উন্নয়নশীল দেশগুলো বের হতে পারছে না, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন না হলে ফ্যাসিবাদের পর ফ্যাসিবাদের বিদায় হলেও নব্য ফ্যাসিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে এতটুকুন কাল বিলম্ব করবে না।
লেখক : শিক্ষাবিদ।