DailySangram-Logo

কলাম

রাসূল (সা.)-এর দাওয়াত

আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর সার্বজনীন দাওয়াত : রাসূলুল্লাহ (সা.) সমগ্র মানবজাতিকে উদ্দেশ করে আল্লাহর নির্দেশের দিকে দাওয়াত প্রদান করেন।

Printed Edition

॥ প্রফেসর আর. কে. শাব্বীর আহমদ ॥

রাসূল (সা.)-এর দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজটি ছিল সার্বজনীন কল্যাণমুখী। দো জাহানের মুক্তির জন্য তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ দীনী দাওয়াতী মিশনটি আজীবন জারি রেখেছেন। দাওয়াত ইলাল্লাহর ভিত্তিতে (সা.) ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থায় রূপ দিয়েছেন মদিনায় একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। যেখানে সব ধর্মের মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার সার্বিক নিরাপত্তা পেয়েছিলো। নবুয়্যত পাওয়ার পর আল্লাহ তা’আলার নির্দেশনা অনুযায়ী (সা.) দাওয়াতী কাজের সূচনা করেন।

আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা : “হে নবী! ডাকো মানুষদেরকে তোমার রব আল্লাহ তাআলার পথে প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা ও উপদেশপূর্ণ ভাষার মাধ্যমে।” -সূরা আন নাহল-১২৫

আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক (সা.) সব শ্রেণির মানুষকে আল্লাহর দীন আল ইসলাম তথা আল কুরআনের হেদায়াতের দিকে উদাত্ত আহ্বান জানান দৃঢ় বিশ্বাস ও আন্তরিক সদুপদেশপূর্ণ মানসিকতায়।

আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর সার্বজনীন দাওয়াত : রাসূলুল্লাহ (সা.) সমগ্র মানবজাতিকে উদ্দেশ করে আল্লাহর নির্দেশের দিকে দাওয়াত প্রদান করেন।

আল-কুরআনের ভাষায় তিনি বলেন : “হে মানব সম্প্রদায়, তোমরা সেই আল্লাহর ইবাদাত বা আনুগত্য করো যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তী মানুষদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা আল্লাহভীরুতার গুণাবলী অর্জন করতে পারো।” -সূরা আল বাকারা-২১

সমাজে আল্লাহর আইন, রাসূলের অনুসরণ ও সৎ লোকদের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে মানুষ মানুষের দাসত্বে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত হয়। নবী রাসূলগণের দাওয়াতী কাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানব রচিত আইনের সমাজব্যবস্থার মূল উৎপাটন করে আল্লাহর আইন ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার বিপ্লব সাধন করা। শেষ নবী (সা.) মদীনায় কুরআানি আইনের ভিত্তিতে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বাস্তব নজির প্রদর্শন করেন। সব শ্রেণির মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করেন। রাসূল (সা.)-এর একদিকে যেমন পরিচয় ছিল দা’ঈ ইলাল্লাহ, আল্লাহর আনুগত্যের দিকে আহ্বানকারী, তেমনি আর এক পরিচয় ছিল সত্যের জীবন্ত সাক্ষ্যরূপে।

আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা : “আমি তোমাদের প্রতি রাসূল পাঠিয়েছি সত্যের সাক্ষ্যরূপে, যেমন সত্যের সাক্ষ্যরূপে রাসূল পাঠিয়েছিলাম ফির’আউনের প্রতি।” -সূরা- আল মুযযামমিল-১৫

বিদায় হজে¦র ভাষণে লক্ষাধিক মুসলিম সাহাবীর উপস্থিতিতেও (সা.) হে ঈমানদার, মুসলিমগণ-সম্বোধন না করে ইয়া আয়্যুহান নাস- হে সমবেত মানবতা বা হে মানবসম্প্রদায় বলে সাত বার সম্বোধন করেছেন। যা ছিল সার্বজনীন কল্যাণকামী দাওয়াতের চেতনা। তাঁর বিদায়ী ভাষণের মূল লক্ষ্য ও টার্গেট ছিল বর্তমান ও অনাগত কালের সমস্ত মানবতার মুক্তির নির্দেশনা। আজকের বিপর্যস্ত পৃথিবীকে শান্তি ও নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে আসার জন্য রাসূলের সেই সার্বজনীন কল্যাণের ভাষণকে পুরোপুরি অনুসরণ করতে হবে। তিনি সমস্ত বর্ণবাদকে অস্বীকার করে এক আল্লাহর নির্দেশকে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে বাস্তবায়নের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, আল্লাহ তা’আলা রাব্বুল আলামীন-সমগ্র সৃষ্টিকুলের পালনকর্তা। আল্লাহর আনুগত্য করলে সমগ্র সৃষ্টি জগতের সব প্রাণী নিরাপদে খেয়ে-পরে জীবন যাপন করতে সক্ষম হবে। রাসূল (সা.) হলেন রহমাতুল্লিল আলামীন-সমগ্র জাহানের সমগ্র সৃষ্টির জন্য রাহমাত বা কল্যাণকামী নবী বা পথপ্রদর্শক। আর আল্লাহ প্রদত্ত আল-কুরআন হলো, হুদাললিননাস-সমগ্র মানবজাতির জন্য মুক্তির পথ-নির্দেশিকা, গাইড লাইন।

মানবরচিত আইনের অসারতা : মানবরচিত আইন মানুষের সমস্যার সমাধান দিতে পারে না।

কার্লমাক্স, লেনিনের মতবাদ, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ-সব অপরিণামদর্শী মতবাদ মানুষের ইহকাল-পরকালের কল্যাণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদেরকে “খাইরে উম্মাহ, উম্মাতে ওয়াসাত-উত্তম জাতি ও মধ্যমপন্থী জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করে মানবকল্যাণে নিবেদিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। (সা.) ও তাঁর সাহাবাগণ আল্লাহর নির্দেশ পালনে জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু আজকের মুসলিম উম্মাহ কি সে দায়িত্ব সঠিকভাবে আনজাম দিচ্ছে! সেটাই আমাদের পর্যালোচনার বিষয়।

রাসূল (সা.) দাওয়াত ইলাল্লাহ সম্প্রসারণ পদ্ধতি : আল্লাহর দীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজ রাসূল (সা.) মক্কা ও মদিনায় ভিন্নতর পদ্ধতিতে আনজাম দিয়েছেন। দাওয়াতে দীনের ভাষা, প্রকাশভঙ্গি, কৌশল পদ্ধতিতে স্থান, কাল বিষয়ে ব্যাপক পার্থক্য ছিল।

মক্কায় তিনি গোপনে তিন বছর তাঁর পরিবার-পরিজন, বন্ধু-স্বজনকে দীনে ইলাহির দাওয়াত প্রদান করেন। পুরুষদের মধ্যে প্রথম দিকে হযরত আবু বকর, আলী রা. দীন ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করেন। মহিলাদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত খাদিজা ও ফাতিমা রা. ইসলাম গ্রহণ করেন। পরে হযরত আবু বকর রা. এর দাওয়াতী প্রচেষ্টায় হযরত উসামা, যোবায়ের, আবদুর রহমান বিন আওফ, সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস, তালহা বিন আবদুল্লাহ, হযরত বেলাল, আবু উবায়দা, আবু সালামা, আরকাম বিন আবুল আরকাম, উসমান বিন মাযঊন, উবায়দা বিন হারিস, খাব্বাব বিন আরত, আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. প্রমুখ ৪০ জন দীনে ইলাহি কবুল করেন। নব মুসলিমদের প্রতি রাসূলের নির্দেশ ছিল গোপনে দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজ করা। গোপনে তিন বছর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঈমানদার সাহাবীগণ দলবদ্ধ ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পারস্পরিক পরামর্শ ও কৌশলগত সহযোগিতায় দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটান।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজে বিরোধিতা : সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব চিরন্তন। রাসূল (সা.) আল্লাহর বিধান আল কুরআনের বাণী তৎকালীন ব্যক্তি ও সমাজে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে হাজারো বাধা-বিপত্তি, নির্যাতন-নিপীড়নের মুখোমুখি হয়েছেন। জন্মভূমি মক্কার যে মানুষগুলো রাসূলের চরিত্র-মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে আল আমীন, আস সাদিক অভিধায় বিভূষিত করেছিলেন, তারাই কালেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”র দাওয়াত শোনার পরই নানা ধরনের অপপ্রচার, অমানবিক আচরণ, নির্যাতন ও সামাজিক বয়কটের মতো হিংস্র ষড়যন্ত্রে নিমগ্ন হয়। (সা.) সম্পর্কে ভিত্তিহীন অপবাদের পাশাপাশি তারা আল্লাহর কিতাব আল কুরআনকেও মুহাম্মাদ সা. রচিত এক কল্পকাহিনী বলে অপপ্রচার করে।

উমাইয়া বিন খালফ রাসূলকে দেখলেই অকথ্য ভাষায় নিন্দা ও কটূক্তি করতো, এমনকি ইতরের মতো তাঁর পবিত্র দেহে থুথু নিক্ষেপ করতো। (লা’নাতাহুল্লাহ)

আবু জাহেল মাকামে ইবরাহীমে রাসূলকে সালাতরত অবস্থায় ঘাড় মটকাতে গিয়ে অদৃশ্য ভয়ে ফিরে আসে। রাসূল (সা.) ও সাহাবাগণকে শেবে আবু তালিবে তিন বছর নির্বাসিত করে অভুক্ত অবস্থায় নির্যাতিত করে। তায়েফে রাসূল (সা.)কে নির্মমভাবে আঘাতের পর আঘাত করে। নবুয়্যতের পঞ্চম বছরে নির্যাতনের মাত্রা অসহনীয় হলে (সা.) সাহাবাদের নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন।

বর্তমান মুসলিম উম্মাহর উদাসীনতা : বর্তমান মুসলিম উম্মাহ দাওয়াত ইলাল্লাহর তৎপরতা থেকে দূরে সরে গিয়ে কাফির পরাশক্তিগুলোর লেজুড়বৃত্তি করছে। বিশ্বে ১৬০ কোটি মুসলমান থাকা সত্ত্বেও তারা পৃথিবীর দেশে দেশে বিশেষ করে ফিলিস্তিন, সিরিয়া, কাশ্মির, বার্মায় মুসলিম নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর মূল কারণ ইসলামী আদর্শ থেকে বিচ্যুতি ও অনৈক্য।

আল্লাহ তাআলা আল কুরআনে ঘোষণা করেছেন : “তোমরা আল্লাহর রজ্জু আল কুরআনকে মজবুত ও ঐক্যবদ্ধভাবে ধারণ করো, সাবধান বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” -আলে ইমরান-১০৩

রাসূল (সা.)-এর ওফাতের পর খোলাফায়ে রাশেদা, উমাইয়া শাসন, উমর বিন আবদুল আজিজের শাসন, ফাতেমীয়, আব্বাসীয়, স্পেনীয় শাসন ও ভারতীয় উপমহাদেশে মোঘল শাসন আমলে মুসলিম শাসকগণ কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক কয়েকশত বছর রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা পরিচালনা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে মুসলমানদের বিলাসিতা, অনৈক্য, দীনী দাওয়াতের কাজে অলসতা ও উদাসীনতার ফলে তারা আল্লাহর নে’আমত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়। অমুসলিমদের হাতে অপমানিত, লাঞ্ছিত হয়। এর চেয়ে লজ্জা ও পরিতাপের বিষয় আর কী হতে পারে!

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মস্থান সৌদি আরবের হারামাইন শরীফাইনের তদারককারী সৌদী বাদশাহ ও প্রিন্সদের সীমাহীন বিলাসিতা ও পার্থিব সম্পদ নিয়ে কলহ-বিবাদ এমনকি গৃহযুদ্ধের আশংকা মুসলিম উম্মাহকে হতাশ করেছে। মুসলমানেরা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়। অথচ আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের অন্যতম চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন : “মু’মিনরা কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেরা একে-অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল, হৃদ্যতাপূর্ণ।” -সূরা আল ফাতহ-২৯।

বিগত তিন দশকে বিভিন্ন মুসলিম দেশে এবং সাম্প্রতিক ইসরাঈল কর্তৃক ফিলিস্তিন হামলায় কমপক্ষে তিন বিলিয়ন মুসলিম নিহত হয়েছে। এর জন্য আল্লাহর দীন প্রচারে পশ্চাদপদ, আদর্শচ্যুত, ঐক্যহীন মুসলমানরাই দায়ী।

তাই আর গাফলতি, উদাসীনতা নয়, এখনই মুসলিম উম্মাহকে দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজে নিবেদিত হয়ে আদর্শ, চরিত্রবান বিশ্বমুসলিমকে ঐক্যের বন্ধনে এনে ইসলামী পুনর্জাগরণে দীক্ষিত করে তুলতে হবে। মুসলমানরা কুরআন-সুন্নাহকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরলে তাদের বিজয় সুনিশ্চিত। বিপদ-আপদ, বিপর্যয়, আঘাত, হামলার পেছনেই রয়েছে মুক্তির সূর্য।

আল্লাহ তা’আলা ঈমানদার মুসলিমদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন : “তোমরা হীনবল হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না, তোমরাই হবে বিজয়ী, যদি তোমরা দৃঢ়ভাবে মু’মিন হিসেবে টিকে থাকো।” -সূরা আলে ইমরান-১৩৯

মুসলিম বিশ্বের নতুন প্রজন্ম যদি রাসূল (সা.)-এর প্রদর্শিত দাওয়াতের পদ্ধতিতে কুরআনি আইন বাস্তবায়নে জীবন ও সম্পদকে আল্লাহর রাস্তায় উজাড় করে দিতে পারে, তাহলে বিশ্বব্যাপী পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান আল কুরআন প্রতিষ্ঠিত হবে। মানবতা পাবে ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি।

লেখক : অধ্যাপক, গবেষক ও কবি।