কলাম
আল্লাহ তা’য়ালার একত্ববাদের প্রমাণ
প্রকৃতপক্ষেই সারা পৃথিবী আল্লাহর তাওহীদের নিদর্শন। পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টি তাঁর একত্ববাদের বাস্তব নিদর্শন বহন করে। মানুষের জীবনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত বাস্তব কিছু নিদর্শন এখানে পেশ করা হলো।
Printed Edition
জাফর আহমাদ
প্রকৃতপক্ষেই সারা পৃথিবী আল্লাহর তাওহীদের নিদর্শন। পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টি তাঁর একত্ববাদের বাস্তব নিদর্শন বহন করে। মানুষের জীবনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত বাস্তব কিছু নিদর্শন এখানে পেশ করা হলো।
এক, মৃত ভূমি জীবিতকরণ ও ফল-মূল উৎপাদন: আল্লাহ তা’আলা বলেন,“এদের জন্য নিষ্প্রাণ ভূমি একটি নিদর্শন। আমি তাকে জীবন দান করেছি এবং তা থেকে শস্য উৎপন্ন করেছি, যা এরা খায়। আমি তার মধ্যে খেজুর ও আংগুরের বাগান সৃষ্টি করেছি এবং তার মধ্যে থেকে ঝরণাধারা উৎসারিত করেছি। যাতে এরা ফল ভক্ষণ করে। এসব কিছু এদের নিজেদের হাতের সৃষ্ট নয়। তারপরও কি এরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।” (সুরা ইয়াসীন: ৩৩-৩৫)
উল্লেখিত আয়াতসমূহে মৃত ভূমি অনুৎপাদন থেকে ভূমির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতাকে যুক্তি হিসেবে পেশ করা হয়েছে। মানুষ দৈনন্দিন ভূমি থেকে উৎপাদিত শস্য-ফলমূল খাচ্ছে। তারা নিজেরা একে একটি মামুলি ব্যাপার মনে করে থাকে। কিন্তু উদাসীনতার পর্দা ছিন্ন করে গভীর দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করলে তারা জানতে পারবে যে, এ ভূমির আস্তরণ ভেদ করে সবুজ শ্যামল ফসল ও বন-বনানীর সৃষ্টি এবং তার মধ্যে নদ-নদী ও স্রোতস্বিনী প্রবাহিত হওয়া এমন কোন খেলা নয় যা নিজে নিজেই চলছে। বরং এর পেছনে সক্রিয় রয়েছে একটি বিরাট জ্ঞান, শক্তি এবং প্রতিপালন ও পরিচালন ব্যবস্থা। প্রশ্ন হচ্ছে, এ নিষ্প্রাণ যমীনের বুক চিরে উদ্ভিদ জীবনের উন্মেষ সম্ভব হলো কেমন করে? এ সম্পর্কে জানা যায় যে, পূর্বেই কয়েকটি বড় বড় কার্যকারণ সংগৃহীত না হলে এ জীবনধারা আদৌ অস্তিত্বলাভই করতে পারতো না।
প্রথমত পৃথিবীর বিশেষ অংশসমূহে তার উপরিভাগের ভূপৃষ্ঠে এমন অনেক জৈবিক উপাদানের আস্তরণ বিছানো হয়েছে যা উদ্ভিদের খাদ্যে পরিণত হবার উপযোগী হতে পারে। এ আস্তরণকে নরম রাখা হয়েছে, যাতে উদ্ভিদের শিকড় তার মধ্যে বিস্তার লাভ করে নিজের খাদ্য আহরণ করতে পারে।
দ্বিতীয়ত যমীনের ওপর বিভিন্ন পদ্ধতিতে পানি সিঞ্চনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে খাদ্য উপাদানসমূহ তার মধ্যে অনুপ্রবেশ করে এমন পর্যায়ে উপনীত হতে পারে যার ফলে উদ্ভিদের শিকড়সমূহ তা চুষে নিতে সক্ষম হয়।
তৃতীয়ত ওপরের শূন্যলোকের বায়ু সৃষ্টি করা হয়েছে। এ বায়ু ঊর্ধ্বলোকের বিপদ-আপদ থেকে যমীনের হেফাজত করে এবং বৃষ্টি পরিবহনের কাজ সম্পাদন করে। এ সংগে এর মধ্যে এমন সব গ্যাসের সমাবেশ ঘটে যা উদ্ভিদের জীবন এবং তাদের বৃদ্ধিও বিকাশ লাভের প্রয়োজন।
চতুর্থত সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে এমনভাবে সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে যার ফলে উদ্ভিদ তাদের জীবন গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় হারে উষ্ণতা এবং অনুকূল পরিবেশ ও মওসুম লাভ করতে পারে।
এখন চারটি বড় বড় কার্যকরণ সৃষ্টি করে দেয়ার পর উদ্ভিদদের অস্তিত্ব লাভ করা সম্ভবপর হয়। তারপর এ উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে দেবার পর উদ্ভিদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এদের মধ্যে থেকে প্রত্যেকের বীজ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যার ফলে যখনই তা উপযোগী জমি, পানি, বাতাস ও মওসুমের সংস্পর্শে আসে তখনই তার মধ্যে উদ্ভিদসুলভ প্রজাতির বীজ থেকে অনিবার্যভাবে একই প্রজাতির চারা তার যাবতীয় শ্রেণী স্বাতন্ত্র্য ও উত্তরাধিকার বৈশিষ্ট্য সহকারে জন্ম নেয়। এর ওপর বাড়তি যে সৃজন কুশলতার অবতারণা করা হয় তা হচ্ছে এই যে, দশ-বিশ বা পঞ্চাশ শ্রেণীর নয় বরং অসংখ্য শ্রেণীর উদ্ভিদ সৃষ্টি করা হয় এবং সেগুলোকে এমনভাবে তৈরি করা হয় যার ফলে তারা অসংখ্য শ্রেণীর পশু ও মানবকূলের খাদ্য, ওষুধ, পোশাক ও অন্যান্য অগণিত প্রয়োজন পূর্ণ করতে সক্ষম হয়, উদ্ভিদের পরে পৃথিবীর বুকে এ প্রয়োজনগুলো অস্তি¡লাভের অপেক্ষায় ছিল।
এ বিস্ময়কর ব্যবস্থা সম্পর্কে যে ব্যক্তিই চিন্তা করবে সে যদি হঠকারিতা ও সংকীর্ণ স্বার্থপ্রীতির শিকার না হয় তাহলে তার অন্তর সাক্ষ্য দিবে, এসব কিছু আপনা-আপনি হতে পারে না। এর মধ্যে সুস্পষ্টভাবে একটি জ্ঞানদীপ্ত পরিকল্পনা কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে মওসুমের সম্পর্ক উদ্ভিদের সাথে এবং উদ্ভিদের সম্পর্ক জীব জন্তু ও মানুষের প্রয়োজনের সাথে চরম স্পর্শকাতরতা ও সূক্ষ্মতা বজায় রেখে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। কোন বুদ্ধি বিবেকবান মানুষ ধারণা করতে পারে না এ ধরনের সর্বব্যাপী সম্পর্ক নিছক ঘটনাক্রমে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তারপর এ ব্যবস্থাপনা আবার এ কথাও প্রমাণ করে না যে, এটি বহু প্রভুর কৃতিত্ব হতে পারে। এটি এমন একজনমাত্র ইলাহর ব্যবস্থাধীনে সম্পাদিত হচ্ছে এবং হতে পারে যিনি মাটি, বাতাস, পানি, সূর্য, উদ্ভিদ, জীবজন্তু ও মানব জাতি সবার স্রষ্টা ও রব। এদের প্রত্যেকের প্রভু যদি আলাদা হতো তাহলে কেমন করে এমনি ধরনের একটি সর্বব্যাপী ও গভীর জ্ঞানময় সম্পর্ক রক্ষাকারী পরিকল্পনা তৈরি হয়ে যাওয়ার এবং লাখ লাখ কোটি কোটি বছর পর্যন্ত এমন সুশৃংখলভাবে যথানিয়মে পরিচালিত হবার কথা কল্পনা করা যেতে পারে।
তাওহীদের সপক্ষে এ যুক্তি পেশ করার পর মহান আল্লাহ বলেন: “তারপরও কি এরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।” (সুরা ইয়াসীন: ৩৫) অর্থাৎ এরা কি এমনই অকৃতজ্ঞ ও নিমকহারাম হয়ে গেছে যে, যে আল্লাহ এদের জীবনের জন্য এ সমস্ত সাজ-সরঞ্জাম সরবরাহ করে দিয়েছেন এরা তাঁর শোকরগুজারী করে না এবং তাঁর নিয়ামতগুলো উদরস্থ করে অন্যের শোকরগুজারী করে। তাঁর সামনে মাথানত করে না এবং তাদের জন্য যে মিথ্যা উপাস্যরা একটি ঘাসও সৃষ্টি করেনি তাদের সামনে মাথা নত করে।
দুই, সব রকমের জোড়া সৃষ্টি: এটি তাওহীদের পক্ষে আরো একটি যুক্তি। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“ পাক-পবিত্র সে সত্তা যিনি সব রকমের জোড়া সৃষ্টি করেছেন, তা ভূমিজাত উদ্ভিদের মধ্য থেকে এবং স্বয়ং এদের নিজেদের প্রজাতির মধ্য থেকে (অর্থাৎ মানব জাতির মধ্য থেকে) এবং এমন জিনিসের মধ্য থেকে যা এরা জানেও না।” (সুরা ইয়াসীন:৩৬)
তিন, রাত একটি নিদর্শন: আল্লাহ তা’আলা বলেন,“এদের জন্য রাত হচ্ছে আর একটি নিদর্শন। আমি তার উপর থেকে দিনকে সরিয়ে দেই তখন এদের ওপর অন্ধকার ছেয়ে যায়।”(সুরা ইয়াসীন:৩৭) রাত-দিনের আসা-যাওয়াও পূর্ব থেকে উপস্থিত সত্যগুলোর অন্যতম। স্বাভাবিকভাবে দুনিয়ায় এগুলো নিয়মিত ঘটে চলেছে বলে নিছক এ জন্য মানুষ এগুলোর প্রতি মনোযোগ দেবার প্রয়োজন বোধ করে না। অথচ যদি দিন কেমন করে আসে, রাত কেমন করে অতিবাহিত হয় এবং দিনের চলে যাওয়ার ও রাতের ফিরে আসার মধ্যে কী কী বিজ্ঞতা ও কৌশল সক্রিয় রয়েছে সে সম্পর্কে সে চিন্তা-ভাবনা করতো তাহলে নিজেই অনুভব করতো যে, এটি একজন শক্তিশালী জ্ঞানবান রবের অস্তিত্ব এবং তাঁর একত্বের উজ্জ্বল প্রমাণ।
চার, সূর্যের সৃষ্টি ও এর গতি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ: আল্লাহ তা’আলা বলেন,“আর সূর্য, সে তার নির্ধারিত গন্তব্যের দিকে ধেয়ে চলছে। এটি প্রবল পরাক্রমশালী জ্ঞানী সত্তার নিয়ন্ত্রিত হিসাব।” (সুরা ইয়াসীন: ৩৮) আল্লাহর শক্তিশালী সৃষ্টির মধ্যে সূর্য অন্যতম। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার এ যুগে এসেও কোন মানুষ এখনো সূর্যের কাছে যাওয়ার জন্য সূর্যযান সৃষ্টি করতে পারেনি। এমন শক্তিশালী সৃষ্টিকে যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁর নাম ‘আজিজ’ মহাপরাক্রমশালী। সৌরজগতে অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্ররাজি বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরছে। এ বিক্ষিপ্তের মাঝে সূর্যের জন্য নির্ধারিত কক্ষপথ নির্ধারণ করে দিয়েছেন যিনি তাঁর নাম ‘আলিম’ মহাজ্ঞানী। সুতরাং শক্তিশালী সূর্যকে নিয়ন্ত্রণ ও তার জন্য নির্ধারিত কক্ষপথ তৈরি করে দেয়ার ক্ষমতা কোন মানুষ, দেব-দেবী বা অন্য কারো ক্ষমতা নেই। সুতরাং সূর্যের সৃষ্টি এবং এর নিয়ন্ত্রণ আল্লাহর তাওহীদের সাক্ষ বহন করে।
পাঁচ, নৌকার সৃষ্টি ও এতে আরোহণ: আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এদের জন্য এটিও একটি নিদর্শন যে, আমি এদের বংশধরদেরকে ভরা নৌকায় চড়িয়ে দিয়েছি এবং তারপর এদের জন্য ঠিক তেমনি আরো নৌযান সৃষ্টি করেছি যেগুলোতে এরা আরোহণ করে। আমি চাইলে এদেরকে ডুবিয়ে দেই, এদের কোন ফরিয়াদ শ্রবণকারী থাকবে না এবং কোনভাবেই এদেরকে বাঁচানো যেতে পারে না। ব্যস, আমার রহমতেই এদেরকে কূলে ভিড়িয়ে দেয় এবং একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত জীবনের দ্বারা লাভবান হবার সুযোগ দিয়ে থাকে।” (সুরা ইয়াসীন:৪২-৪৪)
লেখক : আলেমে দ্বীন ও ব্যাংকার