মতামত
প্রেসিডেন্ট যখন রিয়েল এস্টেট মাফিয়া
সবকিছুতো হচ্ছে চোখের সামনেই। মিডিয়ায় তা ফলাও করে প্রচারও করা হচ্ছে। ডাকাতদের গ্রামের কথা বলছিলাম। এ গ্রামে ডাকাতরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন।
Printed Edition
সবকিছুতো হচ্ছে চোখের সামনেই। মিডিয়ায় তা ফলাও করে প্রচারও করা হচ্ছে। ডাকাতদের গ্রামের কথা বলছিলাম। এ গ্রামে ডাকাতরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। ধরতে পারেন, মারতে পারেন, উচ্ছেদও করতে পারেন। আবার বিচারের নামে লোক দেখানো তামাশাও করতে পারেন। অর্থাৎ সবকিছুর নিরঙ্কুশ মালিকানা ডাকাতগোষ্ঠীর হাতেই। কী চমৎকার ব্যবস্থাপনা! আধুনিক পরিভাষায় বর্তমান বিশ^টা একটা ‘গ্লোবাল ভিলেজ’, যাকে একটি বড়গ্রাম হিসেবে অভিহিত করতে পারি। এমন বড় গ্রামের চিত্রটা কেমন? সভ্যতা কিংবা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে আলাদাভাবে বর্ণনা করার মতো কোনো থিসিস কোনো চিন্তকের কাছে আছে কি? এ প্রসঙ্গে বঙ্গদেশের কোনো মিডিয়া নয়, ফক্স নিউজের বরাত দিয়ে কথা বলতে চাই। ১০ ফেব্রুয়ারি সোমবার আমেরিকার টিভি চ্যানেল ফক্স নিউজকে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, গাজা নিয়ে তাঁর যে পরিকল্পনা, তাতে স্থানীয় ফিলিস্তিনীদের ফিরে আসার কোনো অধিকার থাকবে না। অর্থাৎ ট্রাম্পের যে বিশ^ব্যবস্থাপনা, তাতে ভূমিপুত্র ফিলিস্তিনীদের নিজ ভূমিতে বসবাসের কোনো অধিকার থাকবে না।
দূরবর্তী ভিন দেশের এক রাজা বর্তমান সভ্যতায় এমন রায়ও দিতে পারেন? তবে প্রশ্ন জাগে, এমন রায় দেয়ার ক্ষমতা তাঁকে কে দিল? জাতিসংঘ, মার্কিন জনগণ, কিংবা ঈশ^র? এখানে বলার মত বিষয় হলো, ¯্রষ্টাকে মান্য করলে, প্রফেট ঈসাকে (আ:) সম্মান করলে কোনো রাজা কি এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? ট্রাম্প তার ভাবনার পক্ষ নিয়ে বলেছেন, ‘তাদের বসবাসের একটি ব্যবস্থা করা হবে।’ তবে কোথায় এ আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে তা নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি তিনি। এর আগেও গাজা থেকে স্থানীয় ফিলিস্তিনীদের উচ্ছেদ করে তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থার কথা বলেছেন ট্রাম্প। জর্দান ও মিসরের সাথে এ নিয়ে আলাপ করবেন বলে ওই সময় জানিয়েছিলেন তিনি। এদিকে রোববার ওয়াশিংটন থেকে নিউ অরলিন্সে যাওয়ার পথে বিমানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প ‘গাজা কিনে নিয়ে তার দখলে নেয়ার’ অঙ্গীকারের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘গাজাকে রিয়েল এস্টেট সম্পত্তি’ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলো এর উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত হতে পারেন।
ট্রাম্প আরো বলেন, ‘যেহেতু আমরা এটি পুনর্নির্মাণ করছি, মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোকে এর সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে। আমাদের অনুমতিতে অন্য লোকেরাও তাতে যুক্ত হতে পারে। তবে এর দখল নেয়ার, মালিকানা নেয়ার এবং হামাস যাতে ফিরে আসতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ। একে আর আগের অবস্থায় নিয়ে আসার সুযোগ নেই।’ ট্রাম্পের এমন বক্তব্যে অবাক হতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত একটি দেশের প্রেসিডেন্ট কী করে নিজেকে নিষ্ঠুর আবাসন ব্যবসায়ীতে পতিত করেন? গাজায় ইসরাইলের ‘ধ্বংসযজ্ঞ’ কি মার্কিন প্রেসিডেন্টের রিয়েল এস্টেট দৃষ্টিভঙ্গির ‘কোনো ডেমোলিশ (demolish) কর্মসূচি’ ছিল? এ কারণেই কি এখন ভূমিপুত্র ফিলিস্তিনীদের সেখানে ফিরতে না দিয়ে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার কথা বলা হচ্ছে? এমন অমানবিক ও নিষ্ঠুর কর্মযজ্ঞ ইতিহাসের আর কোনো অধ্যায়ে লক্ষ্য করা যায়নি। নির্মোহ কোনো মানুষ যদি মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন পরিকল্পনাকে এখন নিকৃষ্ট কোনো মাফিয়ার কর্মকা-ের সাথে তুলনা করেন, তখন কি তাকে ভুল বলা যাবে?
প্রশ্ন জাগে, ট্রাম্পের মত কোনো মানুষ কি যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন? প্রেসিডেন্টতো হবেন একজন ‘রাষ্ট্রনায়ক’। তাঁর জীবনদর্শন এবং মানবিক আচরণে পৃথিবী আলোকিত হবে। কিন্তু এ কেমন ‘প্রেসিডেন্ট’, যিনি নিষ্ঠুর রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর মতো আচরণ করেন? এর যোগ্য শাগরেদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি সৌদি আরবে ফিলিস্তিনীদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছেন। সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতির মাধ্যমে নেতানিয়াহুর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গাজায় জাতিগত নিধনসহ ইসরাইলের চলমান অপরাধ থেকে বিশে^র মনোযোগ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিতে নেতানিয়াহু অপচেষ্টা করছেন। সৌদি আরব ফিলিস্তিনীদের নিজ ভূমিতে থাকার অধিকারকে সমর্থন করছে। তারা কোনো বহিরাগত বা অভিবাসী নন যে, নিষ্ঠুর ইসরাইলী দখলদারদের ইচ্ছা অনুসারে যখন খুশি তাদের বিতাড়িত করা যাবে।’
এর আগে গত বৃহস্পতিবার ইসরাইলী টিভি চ্যানেল ফোরটিনে এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, সৌদি কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে তাদের দেশেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এর জন্য তাদের অনেক ভূমি রয়েছে। উপলব্ধি করা যায়, ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু একই সূত্রে গাঁথা। সমস্যা সমাধানের চাইতে সমস্যার মাত্রা বাড়াতেই তারা উৎসাহী। স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত চিন্তা-ভাবনা করার সক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলেছেন। যে কোনো সচেতন মানুষই উপলব্ধি করতে পারবেন, ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর নতুন যে বয়ান, তা মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো পৃথিবীর জন্য কত ভয়ানক হতে পারে। কিন্তু বর্তমান সভ্যতার বড় বড় দেশগুলোর নেতারা তো এ ব্যাপারে তেমন কিছু বলছেন না। নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। যেন কিছুই হচ্ছে না। এ কেমন নৈতিকতা, এ কেমন দায়িত্ববোধ? তবে তাদের অবগতির জন্য বলে রাখা ভালো যে, কুঁড়ে ঘরে আগুন লাগলে প্রাসাদও রেহাই পায়না।
দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প যা করছেন তা শুধু মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নয়, তার দেশের জন্যও ক্ষতিকর। বিশ্লেষকদের বক্তব্যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হচ্ছে। এবার ক্ষমতায় ফিরে প্রথম সপ্তাহেই তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করলেন। কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই ফেডারেল বাজেট আটকে দিয়েছেন। জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকারও বাতিল ঘোষণা করলেন।
ট্রাম্পের এসব কাজ যেন এক অশনি সংকেত। তার কর্মকা-ে আমেরিকার দীর্ঘদিনের শাসনব্যবস্থার প্রতি নাগরিকদের যে আস্থা ছিল তা নষ্ট হচ্ছে। মার্কিন শাসনব্যবস্থায় নানা ত্রুটি থাকলেও, এতদিন তা দেশকে এক সঙ্গে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প তা ধ্বংস করে নতুন এক ‘মিথ’ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। যেখানে একজন নেতার প্রতি সবার অন্ধ আনুগত্য থাকতে হবে। ট্রাম্পের কিছু সমর্থক মনে করেন, তিনি ঈশ^রের মনোনীত একজন নেতা। এ ধরনের অন্ধ ভক্তি সাধারণত চরম একনায়কতন্ত্রে দেখা যায়, যা এর আগে কখনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে যুক্ত হয়নি। এখন যে ‘ট্রাম্পবাদ’ দেখা যাচ্ছে, তা বেশিদিন টিকে নাও থাকতে পারে। কারণ, এর সাথে কোনো শক্তিশালী আদর্শ যুক্ত হয়নি, বরং যুক্ত হয়েছে ট্রাম্পের রাগী ও আত্মকেন্দ্রীক আচরণ। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী না হলেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে গভীরভাবে ধ্বংস করে যেতে পারেন, যা মেরামত করা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের প্রাগ্রসর নাগরিকরা সময় থাকতেই মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন কি?