মতামত পাঠকের অভিমত
মত অভিমত
এ নিষ্ঠুরতার শেষ কোথায়
সম্প্রতি শিশু হত্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। জন্ম থেকেই এসব শিশুরা, পারিবারিক কলহ, পরকীয়া, প্রতিহিংসায় নিষ্ঠুরতমভাবে জীবন দিচ্ছে। গতবছর ২০২৪ এ ঘটেছে মুনতাহা (৬) হত্যা। তাকে হত্যা করেছে তারই গৃহশিক্ষক মারজিয়া আক্তার সুমি।
॥ হাসনা হেনা ॥
সম্প্রতি শিশু হত্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। জন্ম থেকেই এসব শিশুরা, পারিবারিক কলহ, পরকীয়া, প্রতিহিংসায় নিষ্ঠুরতমভাবে জীবন দিচ্ছে। গতবছর ২০২৪ এ ঘটেছে মুনতাহা (৬) হত্যা। তাকে হত্যা করেছে তারই গৃহশিক্ষক মারজিয়া আক্তার সুমি। সামিউল হত্যা সংঘটিত হয়েছে আজ থেকে ১০ বছর আগে পরকীয়ার জেরে। রংপুর মিঠাপুকুরে ৫২ দিন বয়সী এক মেয়ে শিশু হত্যার অভিযোগ উঠেছে তার মায়ের বিরুদ্ধে এবং মাকে অভিযোগ করে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। ঢাকার বনশ্রীতে ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ দুই শিশু হত্যার ঘটনায় মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন শিশু দুজনের বাবা। র্যাব জানায় সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে উনি বাচ্চা দুটোকে হত্যা করেছেন।
গত ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ঐশী আক্তার নামে এক স্কুল শিক্ষিকা তার ৫ দিনের শিশু সন্তানকে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতে ফেলে দেন যা নিয়ে ঐ এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। জানা গেছে, ২০২৩ সালে সোহেল আহমেদের সঙ্গে ঐশী আক্তারের পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। গত ১০ জানুয়ারি সকালে শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেন ঐশী আক্তার। পারিবারিক সংকট এর পেছনে দায়ী বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু নিরপরাধ শিশু কেন এর শিকার হবে?
হত্যা জঘন্যতম অপরাধ। কোন মুসলিম অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে না। মানুষ হত্যার কারণে কুরআন শরীফে অনন্তকাল কাল জাহান্নামে থাকার হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “যে ব্যক্তি কোন মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাববে হত্যা করলো, তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানে চিরকাল থাকবে।” সুরা নিসা-আয়াত -৯৩।
মায়ের হাতে নিজ সন্তান হত্যা ভয়ানক সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দেয়। মায়ের কোল হচ্ছে একটা শিশুর নিরাপদ আশ্রয়স্থল আর তা অনিরাপদ হয়ে যাওয়া কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। একজন গর্ভবতী মহিলা গর্ভস্থ শিশুকে নিয়ে মানসিকচাপে থাকেন। তারমধ্যে হচ্ছে পারিবারিক কলহ, মেয়ে সন্তান জন্ম দেওয়া, অর্থনৈতিক সংকট, প্রসবকালীন নিরাপত্তার নিশ্চয়তার সংকট।
অনেক সময় মা গর্ভধারনের জন্য প্রস্তুত থাকেন না কিন্তু পরিবার কিংবা স্বামীর চাপে বাচ্চা নিলে তারাও মানসিক চাপে থাকেন। বাল্য বিবাহের শিকার যারা তারাও মানসিক রোগের ঝুঁকিতে থাকেন। একজন সদ্য মা হওয়া নারীর মধ্যে তিন ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। পোস্ট পারটাম ব্লুজ, পোস্ট পারটাম ডিপ্রেশন, পোস্ট পারটাম সাইকোসিস। এ রোগ প্রসব পরবর্তী প্রথম কিংবা দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দেখা দিতে পারে। মা তখন অনেক অস্থির থাকেন। তিনি কিছু দেখতে পান এবং গায়েবি আওয়াজ শুনতে পান। তিনি মনে করেন তার এ সন্তান তার পরিবারের জন্য ক্ষতিকারক। তাহলে একে মেরে ফেলা উচিত। তবেই সবার মংগল হবে। এরা সঠিক এবং সময়োপযোগী চিকিৎসায় সুস্থ হয়। এদের পাশে সারাক্ষণ নিকট আত্মীয় কিংবা দরদী কেউ থাকা প্রয়োজন যাতে সহানুভূতির দৃষ্টিতে রোগীকে দেখে যাতে শিশুর কোন ক্ষতি করতে না পারে।
আমাদের দেশের নারীরা অবহেলিত। গত ১৫ জানুয়ারি ঐশী আক্তারের শিশু হত্যার যে ঘটনা তা ভয়ানকভাবে মানসিক অসুস্থতা এবং পারিবারিক কোন্দলের ইংগিত বহন করে। এখানেও দেখা যায় বিয়ের কিছু দিন পর ঐশী আক্তার পরিবারের লোকজনের উস্কানিতে সংসার না ইচ্ছা প্রকাশ করেন। নবজাতকের বাবা সোহেল আহমেদ ও তার পরিবারের লোকজন শিশুটিকে দেখতে গেলে ঐশীর পরিবারের লোকজন তাদের সাথে খারাপ আচরণ করেন এবং তাদের তাড়িয়ে দেন।
শিশুরা নিরস্ত্র ও নিরপরাধ। তাদের এরকম মৃত্যু কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এরকম ঘটনা যাতে না ঘটে এইজন্য মানবতা, মানবিক মূল্য বোধের উৎকর্ষ সাধন একান্ত প্রয়োজন, কোন গর্ভবতী মহিলা কোন ধরনের বিষণœতায় ভুগছেন কিনা সেটাও খেয়াল রাখা অতি প্রয়োজন। কারণ সাইকোসিস বা মনোব্যাধির যথা সময়ে চিকিৎসা না হলে এটা হত্যা কিংবা আত্মাহত্যার মতো ভয়ংকর পরিনতি ডেকে আনে। অল্পে তুষ্ট থাকার মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে।ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার মত মানবিক গুণাবলি বৃদ্ধির প্রয়োজন। গর্ভবতী মায়ের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তার প্রতি যে কোন ধরনের মানসিক, শারীরিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। একটা পারিবারিক বলয়ে সম্প্রসারিত করতে হবে স্নেহ, মায়া, মমতা ও ভালোবাসার মত অনাবিল প্রশান্তির।
লেখিকা : অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, মোহাম্মদপুর মহিলা কলেজ।