মতামত কলাম
এবার হিমালয়ের পানি নিয়ে লড়াই
পৃথিবীর নেতাদের একটি বিষয় সবসময় মনে রাখা উচিত যে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণে ছোট্ট গ্রহটাকে বহু রাষ্ট্রে বিভক্ত করা হলেও আমাদের প্রকৃতি ও জলবায়ু কিন্তু একটাই। এক আকাশের নীচেই সব মানুষের বসবাস। পৃথিবীর ভূগোলে বৈচিত্র্য আছে কিন্তু সবকিছু আবার একই সূত্রে গাঁথা।
পৃথিবী তো মহাবিশ্বের ছোট্ট একটা গ্রহ। মহাবিশ্বের মানচিত্রে পৃথিবীকে হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না। বালুকণার চাইতেও ক্ষুদ্র পৃথিবীটা কিন্তু আমাদের প্রিয় গ্রহ। এ গ্রহে কত রাষ্ট্র, কত রাজনীতি, অর্থনীতি, সমরনীতি এবং সংস্কৃতি। সবাই নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখছি। শক্তিমানরা নিজেরটা শুধু ষোলআনা নয়, সাড়ে ষোলআনা বুঝে নিচ্ছেন। দুর্বলরা হচ্ছে শোষিত, বঞ্চিত। শক্তিমানরা এখানেই থেমে থাকেননি। জুলুম ও অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে বিশ্বময় সৃষ্টি করে রেখেছেন এক ভয়ের পরিবেশ। শক্তিমানদের আবিষ্কৃত নিত্যনতুন গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে রেখেছে। এমন অস্বাভাবিক ও অসুস্থ পরিবেশে বিশ^ নেতারা যেন স্বাভাবিক চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন, করণীয় নির্ধারণেও যেন অক্ষম হয়ে পড়েছেন। অর্থ-সম্পদ ও অস্ত্রভাণ্ডারে সমৃদ্ধ হওয়াই যে সবকিছু নয়, সেই সত্য এখন তাদের উপলব্ধির বাইরে। তারা একথাও ভুলে গেছেন যে, মহাবিশ্বের ছোট্ট গ্রহ পৃথিবীর নাগরিকদের অহংকার করতে নেই বরং ভেবেচিন্তে ন্যায়ানুগভাবে সব কাজ সম্পন্ন করা উচিত।
পৃথিবীর নেতাদের একটি বিষয় সবসময় মনে রাখা উচিত যে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণে ছোট্ট গ্রহটাকে বহু রাষ্ট্রে বিভক্ত করা হলেও আমাদের প্রকৃতি ও জলবায়ু কিন্তু একটাই। এক আকাশের নীচেই সব মানুষের বসবাস। পৃথিবীর ভূগোলে বৈচিত্র্য আছে কিন্তু সবকিছু আবার একই সূত্রে গাঁথা। তাই ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ দর্শনকে বুঝতে ব্যর্থ হলে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবো, এর আগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের প্রিয় পৃথিবী। পৃথিবী তো ইতোমধ্যেই বিবিধ ক্ষতিতে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। অথচ মূর্খের মতো আচরণ করে যাচ্ছেন বর্তমান সভ্যতার দাম্ভিক নেতারা। তারা যাচ্ছেতাইভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করছেন, কার্বনে ভরে দিচ্ছেন আমাদের আকাশকে। পৃথিবীকে উত্তপ্ত করছেন তারা শিল্পের বিকাশ ও প্রবৃদ্ধির নামে।
মানুষকে অনেক কিছুই বলা যায়, কিন্তু প্রকৃতিকে সেভাবে বলা যায় কী? প্রকৃতি নিজের বিধিবদ্ধ নিয়মে চলে। সেখানে কেউ আঘাত করলে প্রকৃতি জবাব দিতে ভুল করে না। বিষয়টিকে অনেকে বলেন, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ।’ প্রকৃতি কাউকে সমীহ করে চলে না। সাম্প্রতিক সময়ের ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যা, ভূমিকম্প এবং যুক্তরাষ্ট্রে দাবানলের ধ্বংসলীলা আমাদের কী বার্তা দেয়? বিজ্ঞান-প্রযুক্তি সেখানে অসহায়, অসহায় যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও। বিশ^াসীরা মনে করেন, সবাইকে নিয়ে বাঁচার মধ্যেই কল্যাণ এবং তার ভিত্তি হবে ন্যায় ও ভালোবাসা। এর বিপরীতে অন্যায় ও নিষ্ঠুরতার তাণ্ডব স্রষ্টা সইবেন না, সইবে না প্রকৃতিও। নিষ্ঠুর সমাজ ও সভ্যতাকে নানাভাবে সতর্ক করেন স্রষ্টা, প্রকৃতিও প্রদর্শন করে বেরি আচরণ। পৃথিবীর ইতিহাসে তো আজাবের বহু উদাহরণ আছে। আদ, সামুদ ও লুত জাতির ধ্বংসের কথা মানুষ ভুলে যায় কেমন করে? বড় বিষয় হলো, গুটিকয় দাম্ভিক মানুষ মানব-সমাজের উপর অত্যাচার চালাবে, কষ্ট দেবে, প্রাণির মতোও বাঁচতে দেবে না। ¯্রষ্টা এসব সইবেন কেমন করে? আমরা মনে করি, বর্তমান সভ্যতার জন্য কোনো সুখবর নেই। আস্থাহীনতায় এই বিশ্বব্যবস্থায় ধ্বংসের অপেক্ষায় আছে দাম্ভিক সভ্যতা। বাঁচার উপায় উপলব্ধি এবং সংশোধন।
ছোট্ট একটি গ্রহের আমরা নাগরিক। মহান ¯্রষ্টা তো মানববান্ধব করে পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু আমরা কি পৃথিবীর প্রতি বান্ধবের মতো আচরণ করছি? পৃথিবীকে ভালোবাসলে তো পৃথিবীর জলবায়ু প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যকে ভালোবাসতে হবে। কিন্তু সভ্যতার শাসকদের আচরণ তো এর বিপরীত। আঞ্চলিক নেতাদের আচরণেও নেই কোনো শুভ বার্তা। জলবায়ু সংকটের কারণে গত বছর বাংলাদেশে তিন কোটি ৩০ লাখ শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও অন্যান্য চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনায় এসব শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। পৃথিবীর জলবায়ু সংকট গবেষকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই সংকটের জন্য দায়ী বড় বড় দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুত দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসছে না। এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পরে তো ডোনাল্ড ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের কথা জানালেন। এটা যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় নীতিগত পরিবর্তন। পরিবেশ গ্রুপ, বিজ্ঞানী এবং আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দ এর নিন্দা জানিয়েছেন। কিন্তু তাতে কী, পরাশক্তি তো কারো কথা শুনতে বাধ্য নন। এমন উদাহরণ মানবসমাজকে আশাবাদী করবে কেমন করে? এদিকে ভারতের আচরণে তিস্তা অববাহিকার জীববৈচিত্র্য ও মানুষের জীবনযাত্রা ধ্বংসের মুখে। তিস্তার উজানে গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করে আসছে। ফলে পানির অভাবে বাংলাদেশ অংশের লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারি জেলার ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা অববাহিকায় জীবনযাত্রা, জীবনবৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে পড়েছে। তিস্তাকে বলা হয়ে থাকে উত্তর জনপদের জীবনরেখা। তিস্তার বুকে ভারতীয় অংশে টইটুম্বুর পানি থাকলেও, একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে এর বাংলাদেশ অংশ যেন মরা খাল। ফলে অস্তিত্ব সংকটে এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, হুমকিতে পরিবেশ। এ নদীর ওপর জীবিকানির্ভর লাখ লাখ মানুষের জীবন আজ বিপন্ন।
পানি বন্টনের ব্যাপারে ভারতের স্বার্থান্ধ, একগুয়েমি ও নীতিহীনতায় তিস্তা তীরবর্তী এলাকা ও এর আশেপাশের প্রকৃতি এখন রুক্ষ। অন্যদিকে বর্ষায় ভারত বন্যা নিয়ন্ত্রণে গজলডোবার সব গেট খুলে দেয়। তখন তিস্তা প্রচন্ডভাবে আছড়ে পড়ে দুই তীরে। ফলে ভাঙে বাংলাদেশের মানুষের বসতভিটা, বিলীন হয় জমির ফসল। এতে প্রতিবছর নিঃস্ব হয় হাজার হাজার পরিবার। ভারতের এমন আচরণ আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির চরম লংঘন। শুধু গজলডোবা বাঁধ নয়, ভারতের ফারাক্কা বাঁধও বাংলাদেশের জন্য চরম ক্ষতিকর বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ভারতের কার্যক্রম প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ুর জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু ভারত এ ব্যাপারে একেবারেই নির্বিকার।
আন্তর্জাতিক নদীগুলো তো কোনো নির্দিষ্ট দেশের জন্য নয়, নদী তো প্রবাহমান, কোনো রাজনৈতিক ভূগোলে সীমাবদ্ধ থাকে না নদী। বাঁধ দিয়ে নদীকে সীমাবদ্ধ করতে চাইলে প্রকৃতি ও জলবায়ুতে মন্দ প্রভাব পড়ে। উজানের দেশগুলোর তো তা না বোঝার কথা নয়। কিন্তু ভারত তা বুঝতে চাইছে না, চীন কি বুঝেছে? চীনের কৈলাস পর্বতের কাছে উৎপন্ন সিয়াং নদী ইয়ারলুংজাংবো নামেও পরিচিত। এটি ভারতের অরুণাচল প্রদেশে প্রবাহিত হয়ে প্রশস্ত হয়। দেশটির বেশিরভাগ অংশে এটি ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত। এরপর এ নদী বাংলাদেশ হয়ে মিলিত হয় বঙ্গোপসাগরে। তিব্বতে মেডগ কাউন্টিতে যেখান থেকে নদীটি ভারতে প্রবেশ করেছে তার ঠিক আগেই বিশে^র বৃহত্তম বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করেছে চীন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারত। ভারতও বসে নেই। চীনা প্রকল্পের প্রতিকূল প্রভাব এড়াতে পাল্টা বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে ভারত। জরিপেরও শুরু করে দিয়েছে তারা। বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন, হিমালয় এলাকার পানির ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বৃহৎ দু’টি দেশের এই লড়াইয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ।
উপলব্ধির বিষয় হলো, বৃহৎ শক্তিগুলো শান্তির বদলে এখন লড়াইয়ে ব্যস্ত। কখনো ভূমি দখলের লড়াই, কখনো অর্থনীতির লড়াই; ভূরাজনীতির লড়াইতো আছেই। এখন আবার বড় হয়ে উঠছে পানির লড়াই। হিমালয়ের পানি নিয়ে যে লড়াই, তার পরিণতি কেমন হতে পারে? বিশেষজ্ঞরা বেশ আগেই হুঁশিয়ার করেছেন যে, রাজনৈতিকভাবে পৃথিবীকে ভাগ করা গেলেও প্রকৃতিকে ভাগ করা যায় না। ক্ষুদ্র স্বার্থে প্রকৃতিকে ভাগ করতে চাইলে, খন্ড-বিখন্ড করতে চাইলে তার পরিণতি মানুষের জন্য ভালো হবে না। মুর্খের আচরণ প্রকৃতি সইবে না। প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে শুরু করলে তা সামাল দিতে পারবে না বিজ্ঞান-প্রযুক্তি কিংবা দাম্ভিক নেতারা। বর্তমান সভ্যতার ইহলৌকিকবাদী নেতারা মহান স্রষ্টার সৃষ্টি নৈপুণ্যকে উপলব্ধি করতে সক্ষম নন। ফলে তারা মূর্খের মত আচরণ করছেন। এদের স্বার্থান্ধ ও দাম্ভিক আচরণে মহাবিশে^র ছোট্ট গ্রহ পৃথিবীটা ক্রমেই মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। বিষয়টি বুঝিয়ে বলার মতো কোনো মহান দার্শনিক কি পৃথিবীতে বর্তমান নেই?