গল্প
ইতিহাসের গল্প
মহানবী (সা)-এর মহান হৃদয়
ইসলামের শহর মদিনা। মুসলিম দুনিয়ার প্রাণকেন্দ্র। একদিন মদিনার বাইরে এসে জমায়েত হয়েছিল অনেক ব্যবসায়ী। তাদের সাথে ছিল অনেক পণ্যসামগ্রী। ছিল অনেক উটও। তার মধ্যে লাল রংয়ের একটি উট ছিল। উটটি দেখতে ছিল ভারি সুন্দর।
Printed Edition

ইকবাল কবীর মোহন
ইসলামের শহর মদিনা। মুসলিম দুনিয়ার প্রাণকেন্দ্র। একদিন মদিনার বাইরে এসে জমায়েত হয়েছিল অনেক ব্যবসায়ী। তাদের সাথে ছিল অনেক পণ্যসামগ্রী। ছিল অনেক উটও। তার মধ্যে লাল রংয়ের একটি উট ছিল। উটটি দেখতে ছিল ভারি সুন্দর। ব্যবসায়ীরা যেখানে জমায়েত হয়েছিল তার পাশ দিয়েই বয়ে গেছে এক মেঠোপথ। মহানবী (সা) হেঁটে যাচ্ছিলেন সেই পথ দিয়ে। হঠাৎ লাল রংয়ের উটটি রাসূল (সা)-এর চোখে পড়ল। তিনি এটাকে খুব পছন্দ করলেন। মনে মনে ঠিক করলেন উটটি তিনি কিনে নেবেন। নবীজি (সা) ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন সামনে, উটের মালিকের কাছে। জানতে চাইলেন উটের দাম। ব্যবসায়ী উটের দাম যা বলল, তা নবীজি (সা)-এর পছন্দ হলো। মহানবী (সা) ব্যবসায়ীকে বললেন, ‘উট তো পছন্দ হলো, সন্ধ্যার সময় দাম পরিশোধ করলে হবে তো?’
ব্যবসায়ী নবীজি (সা)-কে চিনত না। তারপরও কী মনে করে সে তাঁকে উটটি বাকিতে দিয়ে দিলো। কিন্তু পরক্ষণেই ব্যবসায়ী দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল। বাকি নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে নানান রকম আলোচনা শুরু হলো। তাদের কেউ কেউ বলল, একজন অপরিচিত লোককে বাকিতে উট দেয়া ঠিক হয়নি। লোকটি যদি দাম পরিশোধ না করে, তাহলে কী হবে?
চরম অনিশ্চয়তা ব্যবসায়ীর ওপর এসে ভর করল। উট বিক্রেতার মধ্যে হতাশাও জন্ম নিলো। এসব আলোচনার এক ফাঁকে তাদের মধ্যে এক মহিলা মুখ খুলল। সে বলল, তোমাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। তোমরা কি লোকটাকে লক্ষ্য করেছ? কত সুন্দর লোকটার চেহারা, কত শান্ত-সৌম তাঁর মেজাজ। এমন লোক কোনদিন প্রতারণা করতে পারে না। তোমরা নিশ্চিন্ত থাক। আমার বিশ্বাস, দেখো উটের দাম তুমি ঠিকই পেয়ে যাবে।
তারপরও উট বিক্রেতার কিন্তু ভয় কাটে না। মহিলার কথায় সে মোটেও ভরসা পেল না। তার সময় যেন আর কাটে না। দিনভর সে চিন্তায় চিন্তায় কাটাল। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। উট বিক্রেতা অপেক্ষার প্রহর গুনছে। দেখতে দেখতে একজন লোক এসে এখানে হাজির হলো। সে সাথে করে কিছু খাবারও নিয়ে এলো। লোকটি উট বিক্রেতাকে উটের দাম বুঝিয়ে দিলো। সাথে খাবারটুকুও তাকে গ্রহণ করতে বলল। মহানবী (সা) পাঠিয়েছেন এই খাবার। উটের দাম হাতে পেয়ে উট ব্যবসায়ীতো মহাখুশি। তার ওপর খাবার ও খেজুর দেখে সে একটু অবাকই হলো। অন্যান্য ব্যবসায়ীও এতে অবাক না হয়ে পারল না। তাই উট ব্যবসায়ী ক্রেতার ওপর যে সন্দেহ করেছিল তার জন্য সে মনে মনে অনুতপ্ত হলো।
পরের দিনের ঘটনা। ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে মদিনা শহরে প্রবেশ করেছে। হঠাৎ তারা এক জায়গায় অনেক মানুষের একটা জটলা দেখতে পেল। মানুষের ভিড় দেখে তাদের মধ্যে উৎসাহ জাগল। তাই তারা কাছে এগিয়ে গেল। দেখল, একলোক জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন। লোকটাকে তাদের চেনা চেনা মনে হলো। অবশেষে বুঝতে পারল, এ তো সেই লোক যিনি গতকাল লাল রংয়ের উট কিনেছিলেন। ব্যবসায়ীরা লোকটির ভাষণ মন দিয়ে শুনল। তাঁর ভালো ভালো কথা ও সুন্দর উপদেশ শুনে তারা অভিভূত হলো।
এদিকে ঘটল আরেক ঘটনা। একজন আনসার কাফেলার লোকদের দেখে চমকে উঠলেন। তাই তৎক্ষণাৎ তিনি উঠে দাঁড়ালেন। নবীজি (সা)-এর ভাষণ তখনও শেষ হয়নি। কিন্তু আনসারের সেই অপেক্ষা আর সইল না। তিনি নবীজি (সা)-এর ভাষণের মাঝেই কিছু একটা বলতে চাইছিলেন। এটা নবীজির চোখে পড়ল।
আনসার বললেন, হে আল্ল¬াহর রাসূল (সা)! এই ব্যবসায়ীরা বনু ছায়নাবা গোত্রের লোক। এরা ভয়ানক মানুষ। এরা দাগী অপরাধী। এদেরই একজন পূর্বপুরুষ আমাদের বংশের একজনকে হত্যা করেছিল। তাই এদের হত্যা করা উচিত। আপনি হুকুম দিলে এদের এখনই শেষ করে দিতে পারি।
মহানবী (সা) এতক্ষণ আনসারের কথা মন দিয়ে শুনছিলেন। এদিকে আনসারের কথা শুনে ব্যবসায়ীরা ভয় পেয়ে গেল। ওদের মনে কাঁপন ধরে গেল। তাই তারা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করে দিল। রাসূল (সা) গভীর মনোযোগ দিয়ে ব্যবসায়ীদের অস্থিরতা ও ভীতি প্রত্যক্ষ করলেন। তাই তিনি এবার মুখ খুললেন।
মহানবী (সা) বললেন, ‘হে আনসার! তুমি যা বলেছ তা সঠিক নয়। এদের পূর্বপুরুষরা কাকে হত্যা করেছে তা বড় কথা নয়। এদের কেউ তো অপরাধ করেনি। তাই এদের হত্যা করা যায় না। একজনের অপরাধের জন্য অন্য কোনো ভাই শাস্তি পেতে পারে না। নবীজি (সা)-এর কথা শুনে ব্যবসায়ীরা বিস্মিত হলো। মুহূর্তের মধ্যেই তাদের ভয় দূর হয়ে গেল।
এখন তারা ভাবছে, এত সুন্দর কথা লোকটির! তাই তারা তাঁর পরিচয় জানার চেষ্টা করল। অবশেষে ব্যবসায়ীরা লোকটির পরিচয় জানতে পারল।
তিনি হচ্ছেন ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)। মহানবী (সা)-এর মহানুভবতা তাদের অভিভূত করল।