বিদ্যুত-জ্বালানি
দাম বৃদ্ধি নিয়ে বিইআরসির গণশুনানি কাল
গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগে ব্যবসায়ী মহলে উদ্বেগ
গ্যাসের দাম বাড়নোর প্রস্তাব নিয়ে কাল বুধবার গণশুনানি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ভর্তুকির চাপ কমাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ব্যবসায়ীরা।
Printed Edition
গ্যাসের দাম বাড়নোর প্রস্তাব নিয়ে কাল বুধবার গণশুনানি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ভর্তুকির চাপ কমাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, পাইকারি গ্যাসের দাম বাড়াতে নতুন বছরের শুরুতেই বিইআরসিকে প্রস্তাব দিয়েছে রাষ্ট্রীয় তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এরপর তিতাস গ্যাস কোম্পানিসহ সরকারি ছয়টি বিতরণ কোম্পানি খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে।
আবেদনে শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত বয়লারে এবং শিল্প কারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রে (জেনারেটর) বা ক্যাপটিভে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম প্রায় দেড়শ’ শতাংশ বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বর্তমানে বয়লারে প্রতি ঘনমিটারে দাম ৩০ টাকা এবং ক্যাপটিভে ৩১ টাকা ৫০ পয়সা। প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে রাজধানীর বিয়াম অডিটরিয়ামে ‘গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানির’ আয়োজন করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
বিইআরসি এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যে কোনো কোম্পানি প্রস্তাব দিতেই পারে। বিইআরসির দায়িত্ব প্রস্তাব মূল্যায়ন করা। পাইপলাইনে মিটারবিহীন গ্রাহক আসলে মাসে কী পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করছে, সে বিষয়ে সমীক্ষা করার উদ্যোগ কমিশনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে। সমীক্ষা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে তিতাস গ্যাসসহ অন্যান্য বিতরণ কোম্পানিগুলোর দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের উপর রিপোর্ট দেবে বিইআরসির টেকনিক্যাল ইভাল্যুয়েশন কমিটি (টিইসি)।’
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, দ্বিগুণের বেশি প্রস্তাবিত গ্যাসের দাম কার্যকর হলে দেশে নতুন কোনও শিল্প গড়ে উঠবে না। সার্বিকভাবে দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান থাকবে না বলে মন্তব্য করেন অনেকে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, সরকার নতুন শিল্পের জন্য ১৫০ শতাংশ এবং সম্প্রসারণ শিল্পের জন্য ৫০ শতাংশ গ্যাস মূল্য বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এমন পরিকল্পনার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। আমরা আর কেউ শিল্প করতে চাই না। তবে বর্তমান শিল্পকে সহায়তা করবেন না, এটা হতে পারে না। সস্তা গ্যাসের কারণে দেশে শিল্প কারখানা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপত্তা দিতে পারছে না। ব্যাংকে সুদের হার বেশি। এনবিআরেও অন্য সমস্যা আছে। এ অবস্থায় অযৌক্তিকভাবে গ্যাসের দাম বাড়ালে উদ্যোক্তারা কেউ নতুন বিনিয়োগ করবে না। বিদ্যমান ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণও হবে না।
জানা গেছে, গ্যাস সংকট সমাধান করে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের আশ্বাস দিয়ে দুই বছর আগে শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। দাম বাড়লেও গ্যাসের সংকট কাটেনি। শিল্প এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপের অভিযোগ রয়েছে শিল্পমালিকদের। বাসাবাড়িতে চুলায় গ্যাস মেলে না এমন অভিযোগ রাজধানীর অনেক এলাকা থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে যুক্তি দেয়া হয়েছে, ‘যদি গ্যাসের দাম না বাড়ানো হয়, তাহলে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে গিয়ে চলতি বছরে সরকারকে বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হবে।’
পেট্রোবাংলার দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘প্রতি ঘনমিটার এলএনজির বর্তমান আমদানি মূল্য পড়ছে ৬৫ টাকা ৭০ পয়সা। ভ্যাট-ট্যাক্স ও অন্যান্য চার্জ যোগ করলে তা দাঁড়ায় ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা। ফলে এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে গ্যাসের মূল্যের এ ফারাক কমাতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এলএনজি আমদানি করলে চলতি অর্থবছরে পেট্রোবাংলার ঘাটতি হবে প্রায় ১৬ হাজার ১৬১ কোটি ৭১ লাখ টাকা।’
প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, ‘দেশীয় গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ায় শিল্প ও ক্যাপটিভ বিদ্যুতে সর্বাধিক প্রভাব পড়েছে। চাহিদা পূরণ করতে দেশীয় গ্যাসফিল্ডগুলো থেকে পাওয়া গ্যাসের সঙ্গে ২৫ শতাংশ এলএনজি আমদানি করে সরবরাহ করা হচ্ছে। আগামীতে ক্রমান্বয়ে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে এবং এলএনজি আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। ২০৩০-৩১ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ দাঁড়াবে ৭৫ শতাংশ।’
বিইআরসিতে বিতরণ কোম্পানিগুলোর জমা দেয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘সব মিটারবিহীন গ্রাহকের আঙিনায় প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের পূর্ব পর্যন্ত গ্যাস বিপণন নিয়মাবলী-২০১৪ অনুযায়ী এক চুলা (সিঙ্গেল বার্নার) ও দুই চুলার (ডাবল বার্নার) গ্যাস ভোগ নির্ধারণ করা হলে তা প্রকৃত গ্যাস ব্যবহারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। ওই নিয়মাবলীতে, এক চুলায় ৭৩ দশমিক ৪১ ঘনমিটার এবং দুই চুলায় ৭৭ দশমিক ৪১ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার ধরে পাইপলাইনের মিটারবিহীন গ্রাহকদের বিল নির্ধারণ করা আছে। বাখরাবাদ ও কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির প্রস্তাব আমলে নেয়া হলে মিটারবিহীন গ্রাহকদের এক ও দুই চুলার বিল যথাক্রমে ১৩২১ ও ১৩৯৩ টাকা হবে।
বিইআরসি সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে পেট্রোবাংলার পাইকারি গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হবে। এরপর ছয় বিতরণ কোম্পানি- তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল), কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল), জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (জেজিটিডিসিএল), বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (বিজিডিসিএল), পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (পিজিসিএল) এবং সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (এসজিসিএল) প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হবে। গণশুনানি বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার, সরকারি-বেসরকারি কোম্পানি, ভোক্তাসহ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার ১১ টাকা ৫৮ পয়সার গ্যাস বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়। ওই সময় শিল্পে ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানো হয়। তবে দাম বাড়ানোর পর থেকেই গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা আরও খারাপ হয়। পরবর্তী সময়ে যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। ২০২২ সালের আগে যে শিল্প ইউনিটে গ্যাসের বিল ২ কোটি ১০ টাকা ছিল, দাম বাড়ানোর পর সেটি ৫ কোটি ২৫ লাখ হয়। প্রস্তাবিত মূল্য কার্যকর হলে সেটি বেড়ে হবে ১৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে কারখানা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশে যে গ্যাস মজুদ রয়েছে এই গ্যাস উত্তোলনের বড় কোনো পরিকল্পনা নেই। আগের সরকার এলএনজি বিশেষত স্পট মার্কেটের এলএনজি কেনায় বেশি আগ্রহী ছিল, এই সরকারও তাই করছে। জ্বালানি নিরাপত্তা সংহত করতে হলে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে হবে।
বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, বুধবার শুনানি থাকায় এ বিষয়ে তার বেশি কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে তারা যেন যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সে জন্য সব পক্ষের কথা শুনছেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার গ্যাস সংকট কাটিয়ে উঠতে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে।