রাজনীতি
ছাত্র-জনতার বিপ্লব : গৌরব গাঁথা
মুনতাসির রহমান আলিফের আলেম হওয়ার স্বপ্ন কেড়ে নেয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা
৫ আগস্ট ২০২৪ সোমবার দিন ঢাকা মেডিক্যালের গেট থেকে ইমার্জেন্সি পর্যন্ত রক্ত আর রক্ত। মর্গের সামনে একটা ঘরে অসংখ্য লাশ স্তূপ করে রাখা। ঐ ঘরের মেঝেতে দাঁড়াতেই রক্তে পা ডুবে যায়।
Printed Edition
মুহাম্মদ নূরে আলম : জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে যারা শহীদ হয়েছেন, তারা একটি বৈষম্যহীন, মানবিক ও দুর্নীতি-দুঃশাসনমুক্ত বাংলাদেশ চেয়েছিল। তেমনই একটি বাংলাদেশ চেয়েছিল তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী শহীদ সৈয়দ মুনতাসির রহমান আলিফ। ৫ আগস্ট ২০২৪ সোমবার দিন ঢাকা মেডিক্যালের গেট থেকে ইমার্জেন্সি পর্যন্ত রক্ত আর রক্ত। মর্গের সামনে একটা ঘরে অসংখ্য লাশ স্তূপ করে রাখা। ঐ ঘরের মেঝেতে দাঁড়াতেই রক্তে পা ডুবে যায়। এর মধ্যে দেখি কারো মাথায় পতাকা বাঁধা, কারো শরীর পতাকায় ঢেকে দেওয়া। এর মধ্যে হঠাৎ চোখ যায়, লাশের স্তূপের ভেতর, একটা হাত দেখা যাচ্ছে। গায়ে কালো টি-শার্ট। আমি ঐ ঘরের দায়িত্বে থাকা লোকদের বলি লাশটা দেখাতে, কিন্তু তারা বলেন, আপনি কনফার্ম হলে আমরা দেখাব, তা না হলে দেখানো যাবে না। এত লাশ ওলটপালট করা যাবে না। আমি আরও কিছুক্ষণ লাশের স্তূপে আলিফকে দেখে নিশ্চিত হই এটাই আমার ছেলের লাশ হবে। ছেলে বাসায় ব্যায়াম করত, তার সুঠাম বাহু এবং সাদা পায়জামা ও কালো টি-শার্ট দেখে বলি ‘আমি কনফার্ম’। আপনারা আমাকে মুখটা দেখান। আলিফের বাবা সৈয়দ গাজিউর রহমান ছেলের গুলীবিদ্ধ রক্তাক্ত মুখটি দেখে হুহু করে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলেন। ‘বেঁচে থাকলে সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখ ছেলেটার ১৫ বছর পূর্ণ হতো। কিন্তু তা হওয়ার আগেই ঝরে গেল ছেলেটা’ কথাগুলো বলছিলেন ৫ আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ হওয়া সৈয়দ মুনতাসির রহমান আলিফের বাবা সৈয়দ মো. গাজীউর রহমান। শহীদ মুনতাসির রহমানের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের দৌলখাঁড় ইউনিয়নের দেওভা-ার সৈয়দ বাড়ি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি ডাইরেক্টর বাবা সৈয়দ গাজিউর রহমান ও মা শিরীন সুলতানার একমাত্র ছেলে মুনতাসির। তিনি মিরহাজারীবাগ তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসায় বিজ্ঞান বিভাগে আলিম প্রথম বর্ষে ভর্তি হন।
যেভাবে শহীদ হন : সোমবার (৫ আগস্ট ২০২৪) সকাল ৯টার দিকে, সেনাবাহিনী এসে যাত্রাবাড়ী থানার সব পুলিশ সদস্যের নিয়ে যায়। ওই সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা থানার দখল নিয়ে থানার গেট আটকে দেয়। এ সময় আন্দোলনরত ছাত্ররা দূর থেকে যাত্রাবাড়ী থানা ঘেরাও করে রাখেন। ফলে থানার দখল নেয়া আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ থানা থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র নিয়ে ছাত্রদের ওপর বেপরোয়াভাবে গুলী করতে থাকেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা যাত্রাবাড়ী এলাকার বিভিন্ন অলিগলিতে ঢুকেও অনেক ছাত্রকে গুলী করে হত্যা করে। সেখানেই মুনতাসির রহমান মাথায় গুলীবিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকে। শহীদ সৈয়দ মুনতাসির রহমান আলিফের বাবা সৈয়দ গাজিউর রহমান ছেলের মাথায় গুলীবিদ্ধ ও রক্তাক্ত নিথর দেহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের লাশঘরের অনেক লাশের স্তূপের মাঝে খুঁজে পান। ছেলের মাথায় গুলী লেগে চোখের নিচ দিয়ে বের হয়ে যায়। গুলীবিদ্ধ রক্তাক্ত মাথা জাতীয় পতাকা দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়। যাতে রক্ত বের না হয়। ৫ আগস্ট দিবাগত রাত দেড়টার দিকে বাবা সৈয়দ গাজিউর রহমান ছেলের মাথায় গুলীবিদ্ধ ও রক্তাক্ত নিথর দেহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের লাশঘরের অনেক লাশের স্তূপের মাঝে খুঁজে পান। ছেলের মাথায় গুলী লেগে চোখের নিচ দিয়ে বের হয়ে যায়।
পিতামাতা ও শিক্ষকের অভিব্যক্তি : শহীদ সৈয়দ মুনতাসির রহমান আলিফের বাবা সৈয়দ গাজিউর রহমান বলেন, শহীদদের দিকে তাকিয়ে জুলাই বিপ্লবের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ এমন কোনো অপকর্ম কেউ না করি। যদি করি তবে শহীদদের আত্মা কষ্ট পাবে, তাদের রক্তকে অপমান করা হবে। ছেলের বিনিময়ে আমি কিছু চাই না। ছাত্ররা চাকরিতে কোটাপ্রথা বাতিল, সন্ত্রাস, দুর্নীতিমুক্ত দেশ, মুনাফাখোর, মজুদদারি, সিন্ডিকেট, অর্থ লুটকারীরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, বাকস্বাধীনতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য আন্দোলন করেছেন। তাদের দাবিগুলো বাস্তবায়নের জন্য খোদাভীরু, সৎ, দক্ষ ও যোগ্য লোক ক্ষমতায় আসতে হবে। তাদের দাবিগুলো বাস্তবায়ন হলে আমার ছেলের স্বপ্ন পূরণ হবে। শহীদ সৈয়দ মুনতাসির রহমান আলিফ (১৫) তার বাবাকে বলতেন, দেশে কিসের স্বাধীনতা? আমরা চাকরি পাবো না। কথা বলতে পারি না। দেশ স্বাধীন না হলে, আমি লেখাপড়া করব না। আবার দেশ স্বাধীনের জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধ করে আমি শহীদ হবো। শহীদ মুনতাসিরের প্রাণের বিনিময়ে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা নতুন বাংলাদেশ পেলেও মুনতাসির তা দেখে যেতে পারলেন না।
শহীদ মুনতাসিরের বাবা গাজীউর রহমান বলেন, আজ পর্যন্ত যত মামলা হয়েছে যাত্রাবাড়ী ছাড়া আর কোথাও কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে দেখি নাই। তাহলে কী হইতেছে, আজ পাঁচ-ছয় মাস হয়ে গেল কোনো পুলিশ হেলমেট বাহিনী অন্তত আমার মামলায় কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। এদের যদি বিচার না হয় তাহলে আমাদের কী হবে, আমরা প্রত্যেকে তাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছি।
তিনি বলেন, একমাত্র সন্তানকে হাফেজ করতে ছোটবেলায় মাদ্রাসায় দিয়েছিলাম। কুরআনে হাফেজ হতে পারেনি, কিন্তু মাদ্রাসা থেকে এ প্লাস পেয়ে দাখিল (এসএসসি) পাস করে। আলিম প্রথম বর্ষের পরীক্ষার পর বললাম, ‘চলো গ্রামের বাড়ি নাঙ্গলকোট ঘুরে আসি, কিন্তু ছেলে বলে, ‘বাবা আমাকে কম্পিউটার আর ইংরেজি ভাষা শিখতে কোচিংয়ে ভর্তি করে দাও’। আমি ছেলের কথামতো ১০ হাজার টাকা দিয়ে কোচিংয়ে দুই বিষয়েই ভর্তি করিয়ে দিই। সেই কোচিং থেকে বন্ধুরা মিলে আন্দোলনে যাওয়া শুরু। ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদসহ আরও অনেকে যখন গুলীবিদ্ধ হয়ে মারা যায়, তারপর থেকে ছেলে চুপি চুপি আন্দোলনে যেত, আমরা জানতাম না। যখন জানলাম, ছেলে আন্দোলনে যাচ্ছে, তখন আমি খুব শঙ্কিত ছিলাম। এত বাচ্চারা আহত-নিহত হচ্ছে, আমার একটাই ছেলে, ‘ওর যদি কিছু হয়ে যায়’! সেই আশঙ্কাই থেকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু আলিফের এক কথা ‘মরে গেলে যাব, তবু আন্দোলনে যাব। বড় ভাইদের প্রাণ যাচ্ছে, আমি ঘরে বসে থাকব না’।
বাবা’র বর্ণনায় সৈয়দ মুনতাসির রহমান আলিফের শহীদ হওয়ার ঘটনা: আলিফ আন্দোলনে শেষ যায় ৫ আগস্ট ২০২৪। সেদিন ছেলেকে ঘরে তালা দিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু তার পরেও শেষ রক্ষা হলো না। ৫ আগস্ট ২০২৪ যখন আলিফ আন্দোলনে গেল, দুপুরের পর জানলাম, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু বিকাল হয়ে গেলেও আলিফ বাসায় আসছিল না, ওর বন্ধুদের দু-এক জনকে ফোন করে জানতে চাইলাম, আলিফের কথা। বন্ধুরা জানালো, ‘আঙ্কেল চিন্তা কইরেন না, অনেকে তো আজ শাহবাগ, গণভবন গেছে, হয়তো আলিফও ওদিকে গেছে’। কিন্তু আমি বললাম, সব রাস্তা বন্ধ, ও শাহবাগ যাবে কী করে? এরপর সন্ধ্যায় বিভিন্ন মসজিদ থেকে মাইকিং হচ্ছিল যেখানে যেখানে লাশ পড়েছিল ‘এত বছর বয়সের ছেলের লাশ পাওয়া গেছে’। আমি গেলাম দুই জায়গায়, দেখি না আমার ছেলে নয়। এরপর স্থানীয় হাসপাতালে গেলাম, ওরা জানাল, মারাত্মক আহত যারা, তাদের আমরা ঢাকা মেডিক্যালে পাঠিয়ে দিচ্ছি, সেখানে খোঁজ নিতে পারেন। ওর বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে রাত ১০টার দিকে ঢাকা মেডিক্যালের দিকে রওনা হই। কিন্তু সেদিন রাতে পথে পথে ব্যারিকেড আর গোলাগুলী চলছিল, তখন যাত্রাবাড়ী থানা লুট হয়ে গেছে, সড়কে ভয়াবহ অবস্থা। আমরা যখন ঢাকা মেডিক্যালে পৌঁছাই তখন রাত আনুমানিক ১২টা।
বাবা গাজীউর বলেন, আমার এক চাচাতো ভাই ঢাকা মেডিক্যালের ব্রাদার। ওকে ডেকে নিয়ে লাশ ঘরের দিকে যায়। লাশ ঘরের লোক বলেন, লাশের স্তূপ থেকে আমার ছেলের রক্তাক্ত দেহ দেখে কনফার্ম করি এটাই আমার ছেলে আলিফ। লাশের মাথায় গুলী লাগা ছিল, এরপর ওরা আমার ছেলের লাশটা বের করে দেয়। কিন্তু লাশের গায়ে কোনো নম্বর বা অন্য কিছু ছিল না। ওরা বলে, ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দেওয়া যাবে না। কিন্তু আমার চাচাতো ভাই বলার পর ওরা আমার ছেলের লাশ দেয়। অ্যাম্বুলেন্সের চালক বলেন, ‘এত রক্তমাখা লাশ, ধুইয়ে নিয়ে যান, তা না হলে অনেকে গোসল দিতে চাইবে না’। তখন ছেলের লাশ সেগুনবাগিচায় কোয়ান্টামে নিয়ে যাই। ওরা গোসল দিয়ে কাপড় পরিয়ে ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ চায়। ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া তারা লাশ দেবে না। তখন তাদের বিষয়টি বুঝিয়ে বন্ডসই দিয়ে ছেলের লাশ নিয়ে আসি। যাত্রাবাড়ীর বাসায় যখন পৌঁছাই তখন ভোর ৪টা। সেখানে আলিফের মাকে নিয়ে আমরা ভোরেই গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার নাঙ্গলকোর্ট চলে যাই। জোহরের নামাযের পর পারিবারিক কবরস্থানে ছেলেকে দাফন করি।