জাতীয়
শেষ হলো ৩ দিনব্যাপী সম্মেলন
ডিসিরাও আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়
তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন শেষ হয়েছে। গত রবিবার সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ডিসিদের মুক্ত আলোচনা হয়। গতকাল মঙ্গলবার শেষ হয় সম্মেলন।
Printed Edition
*মেধাবী ডিসিদের জনগণের নিপীড়নে বিগতদিনে কাজে লাগিয়েছে ফ্যাসিস্টরা
তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন শেষ হয়েছে। গত রবিবার সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ডিসিদের মুক্ত আলোচনা হয়। গতকাল মঙ্গলবার শেষ হয় সম্মেলন। এবারের ডিসি সম্মেলনে সারা দেশ থেকে ৩৫৩টি প্রস্তাব উঠেছে। সম্মেলনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে মোট ৩৪টি কার্য-অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়ে। কার্য-অধিবেশনগুলো অনুষ্ঠিত হয় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে।
রেওয়াজ থাকলেও এবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ডিসিদের সৌজন্য সাক্ষাতের সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে এ বছর রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারদের সাক্ষাৎ হয়নি।
ডিসি সম্মেলনের তৃতীয় দিন মঙ্গলবার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, জননিরাপত্তা বিভাগ, সুরক্ষা সেবা বিভাগ, কৃষি মন্ত্রণালয়, আইন ও বিচার বিভাগ, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা হয়।
এছাড়াও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত বিষয়াদি, মন্ত্রিপরিষদ সংক্রান্ত বিষয়াদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। পরবর্তীতে ফিডব্যাক অধিবেশন ও সম্মেলনের মূল্যায়ন এবং সমাপনী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
এবারের সম্মেলনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। এছাড়াও জনসেবা, জনদুর্ভোগ, রাস্তাঘাট নির্মাণ, আইনকানুন ও বিধিমালা সংশোধন এবং জনস্বার্থের বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে এই সম্মেলনে।
দুপুরে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের শেষ দিনের প্রথম কর্ম অধিবেশন শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, বিগত ফ্যাসিস্টরা ডিসিদের (জেলা প্রশাসক) জনগণের নিপীড়নে কাজে লাগিয়েছে। আমরা চাই আগামী দিনে যারা ক্ষমতায় আসবেন, প্রশাসন ক্যাডারের এই অসীম সম্ভাবনাগুলোকে তারা যেন জনগণের নিপীড়নে কাজে না লাগান।
আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের ডিসিরা আসলেই অনেক কিছু জানেন। কারণ, কম্পিটিটিভ পরীক্ষার মাধ্যমে সবচেয়ে মেধাবী মানুষরাই প্রশাসনে আসেন এবং ডিসি হিসেবে কাজ করেন।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রের এত বড় একটা রিসোর্সকে গত ফ্যাসিজম জনগণকে অত্যাচার-নির্যাতন করার জন্য এবং নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য ব্যবহার করেছে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, আমরা যদি ডিসিদের ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারি, বিশেষ করে রাষ্ট্রের সেবা করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও সুন্দর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য, তাহলে আগামী দিনে দেশের জন্য ভালো কিছু করা সম্ভব। আমি মনে করি, সেটুকু মানসিকতা তাদের আছে।
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এবার নির্বাচনে জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) নির্ভয়ে কাজ করতে পারবেন। তাদের ওপর কোনো ধরনের চাপ বা প্রভাব থাকবে না মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক সম্মেলনে অধিবেশন শেষে ব্রিফিংয়ে রিজওয়ানা হাসান এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, এবারের নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হবে উল্লেখ্য করে তিনি বলেন, ‘তাই এবার ডিসিদের দলীয় তকমা থাকার সুযোগ নেই। এর পরও কোনো ডিসির ব্যাপারে কারো কোনো আপত্তি থাকলে আমাদের জানালে বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এবারের নির্বাচনে ডিসিরা নির্ভয়ে কাজ করতে পারবেন। কারণ, নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করার জন্য কোনো দলের পক্ষ থেকে প্রভাবিত করার সুযোগ নেই।’
আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে হওয়া বড় দুর্নীতির খবর ধামাচাপা না দিতে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নির্দেশ দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। ডিসিরাও দুর্নীতির সঙ্গে আপস করবেন না বলে আশ্বাস দিয়েছেন। আর আগামী নির্বাচন ভালো হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং শ্রম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম।
এদিকে বিদ্যুৎ-সংকট মোকাবিলায় সচিবালয়সহ সরকারি-বেসরকারি অফিস, মসজিদ ও বাসাবাড়িতে এসির ব্যবহার ২৫ ডিগ্রি রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেছেন, কোথাও এর ব্যত্যয় ঘটলে সে এলাকায় লোডশেডিং করা হবে।
খাদ্য ও ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, আসন্ন রমজানে খাদ্যশস্য সুলভ মূল্যে এবং ক্ষেত্র বিশেষে বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। এই কার্যক্রম সুশৃঙ্খলভাবে পালনে ডিসিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, রাজস্ব আয় বাড়াতে করের আওতায় আনা হবে দেশের চিকিৎসক ও জেলা, উপজেলা ও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের ব্যবসায়ী ও আইনজীবীদের।
এছাড়া মৎস্য উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, প্রাথমিকভাবে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থানরত বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্য ১১ হাজার টন ইলিশ রপ্তানি করা হবে।
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘অতিরিক্ত চাপ’ থেকে ডিসিরাও আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় । সারাদেশে জনপ্রতিনিধি না থাকায় জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) অতিরিক্ত সময় দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এমনকি অতিরিক্ত চাপ থেকে মুক্তি পেতে তারাও দ্রুততম সময়ের মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। মঙ্গলবার দুপুরে তিন দিনের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে বক্তব্য শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
আসিফ মাহমুদ বলেন, আপনারা জানেন দেশে একটি বিশেষ পরিস্থিতি যাচ্ছে। আমাদের স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় জনপ্রতিনিধিরা নেই। তাদের দায়িত্বগুলো বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকরা পালন করছেন। সেই জায়গা থেকে তাদের যে সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে, আজকের ডিসি সম্মেলনে আমরা সেগুলো শুনেছি এবং এগুলো এড্রেস করেছি।
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের সম্ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভাগীয় কমিশনারদের প্রত্যেকেই মূল দায়িত্বের বাইরে কিছু না কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। জেলা প্রশাসকদের অতিরিক্ত সময়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। সমস্যাটা হলো, একজন অফিসার যখন নিজ দায়িত্বের বাইরে আরও দুই-তিনটা দায়িত্ব পালন করেন, তার পক্ষে কোনটাই যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যে কারণে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি জাতীয় নির্বাচনের আগেই স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বে নিয়ে আসা উচিত।
অন্তর্বর্তী সরকারের এই উপদেষ্টা আরও বলেন, সর্বশেষ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মিটিংয়েও স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনা এখনো চলমান আছে, চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত এখনো সরকার নেয়নি। আশা করছি খুব দ্রুতই কোনো একটা সিদ্ধান্ত আসবে। হয় আমরা দ্রুতই জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করবো, অন্যথায় প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের সমস্যাগুলো সমাধান করা হবে।
দুর্নীতি কমাতে না পারলে দেশের কাক্সিক্ষত অগ্রগতি হবে না বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দুর্নীতি। এটিকে সমূলে বিনষ্ট করতে না পারলে দেশের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হবে না। সব লেভেল থেকে দুর্নীতি কমাতে হবে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, জেলা প্রশাসকরা সীমান্ত এলাকায় আরও বেশি হারে বিজিবি মোতায়েন, নৌপথের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে নৌ পুলিশ বৃদ্ধি করার কথা বলেছেন। তাছাড়া তারা গাজীপুর মেট্রোপলিটন এলাকা ও শিল্প পুলিশের জনবল বৃদ্ধির কথা বলেছেন। আমরা বিষয়সমূহ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি ও বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছি।
বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটামুটি ভালো আছে জানিয়ে তিনি বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাতে আরও উন্নতি হয়, সেজন্য সারাদেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনা করা হচ্ছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে হাইকোর্ট ৬ হাজার ৫৩১ জনের নিয়োগ বাতিল করলেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার জানিয়েছেন, আইনি প্রক্রিয়া মেনে সরকারি শিক্ষক নিয়োগের ফল ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা আন্দোলনরত সহকারী শিক্ষকদের প্রতি সহানুভূতিশীল। মঙ্গলবার জেলা প্রশাসক সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কার্য-অধিবেশন শেষে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
গণশিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, আন্দোলনরত শিক্ষকদের বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। যেহেতু এটি এখন আদালতে বিচারাধীন বিষয় তাই প্রশাসনিকভাবে আলাদা কোনো উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ নেই।
উপদেষ্টা বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, যখন ফল ঘোষণা করা হয়েছে, আমাদের মন্ত্রণালয় স্বাধীনভাবে ফল ঘোষণা করেনি। আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়েই ফল ঘোষণা করেছি। ফলে আমরা মনে করছি, আইনি কাঠামোতেই আমাদের কাজগুলো করেছি। সে হিসেবে তারা যেটা চাচ্ছেন তাদের সঙ্গে আমাদের সহানুভূতি রয়েছে। কারণ আমরা মনে করছি আমরা আইনসম্মতভাবেই করেছি। নতুন পাঠ্যবই নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রাথমিকের ৮৫ শতাংশ বই স্কুলে পৌঁছে গেছে। এ মাসের মধ্যে স্কুলে স্কুলে সব বই পৌঁছে যাবে।