DailySangram-Logo

জাতীয়

সিএনজি মিটারে বেশি ভাড়া নিলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা

রাজধানীতে পরিবহনে নৈরাজ্য চরম ভোগান্তি যাত্রী সাধারণের

রাজধানীতে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো ও শতভাগ যাত্রীসেবা নিশ্চিতে টিকিট কাউন্টারভিত্তিক বাস সার্ভিস চালু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু সরকারের এ সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করেছেন গণপরিবহন শ্রমিকরা। ফলে সোমবারের মতো গতকাল মঙ্গলবারও বন্ধ ছিল অধিকাংশ গণপরিবহন। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা।

স্টাফ রিপোর্টার
Printed Edition

রাজধানীতে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো ও শতভাগ যাত্রীসেবা নিশ্চিতে টিকিট কাউন্টারভিত্তিক বাস সার্ভিস চালু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু সরকারের এ সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করেছেন গণপরিবহন শ্রমিকরা। ফলে সোমবারের মতো গতকাল মঙ্গলবারও বন্ধ ছিল অধিকাংশ গণপরিবহন। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও বাসের দেখা মিলেনি। আর কোথাও কোথাও বাসের দেখা মিললেও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না।

জানা গেছে রাজধানীতে কাউন্টারভিত্তিক বাস সার্ভিস চালুর পাঁচ দিনের মাথায় পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয়েছে। রাজধানীতে গত ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির উদ্যোগে চালু করা হয় ই-টিকেটিং পদ্ধতি ও কাউন্টারভিত্তিক বাস সার্ভিস।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর সায়েদাবাদ, মুগদা, বাসাবো, খিলগাঁও, মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা এলাকায় সড়কের পাশে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন বহু মানুষ। দুই একটা বাসের দেখা মিললেও তাতে উঠার মতো পরিস্থিতি নেই। অনেকেই বাসের দেখা না পেয়ে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে রওনা হচ্ছেন। আর যাদের সামর্থ্য আছে তারা রিকশা, সিএনজি বা রাইড শেয়ারের মাধ্যমে গন্তব্যে ছুটছেন।

তবে বাসের জন্য অপেক্ষারত অনেকেই জানেন না যে, মঙ্গলবার সড়কে বাস চলাচল করছে না। ফলে তারা দীর্ঘ সময় ধরে বাসের জন্য অপেক্ষা করে পড়েছেন ভোগান্তিতে। রাজধানীর ধোলাইপাড়ে রাইদা বাসের জন্য অপেক্ষারত এক যাত্রী জানেন না যে বাস চলাচল করছে না। তিনি জানান, ‘এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি, কিন্তু কোনো বাস নেই। মনে হচ্ছে কোনো সমস্যা হয়েছে। কীভাবে এয়ারপোর্ট যাব বুঝতেছি না।’

এই যাত্রীকে বাস না চলার কারণ জানাতে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। আরেক যাত্রী বলেন, ‘গুলিস্তান যামু, অনেকক্ষণ ধইরা দাঁড়াই আছি, যাও দু-একটা ভিক্টর ও আকাশ বাস আসতেছে উঠাই যাচ্ছে না।’

ভিক্টর বাসের চালক আবুল হাসেম বলেন, গোলাপি রং করতে গিয়ে অনেক বাসই নামেনি রাস্তায়। আর ই-টিকিটিংয়ে চালক-হেলপারের ক্ষতি হচ্ছে বলে অনেকে বাস চালাচ্ছেন না।

এর আগে, সোমবার সায়েদাবাদে বাস চালক-শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করেন আগের মতোই যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী তোলার দাবিতে। এতে জনপথ থেকে সায়েদাবাদ টার্মিনাল পর্যন্ত সড়ক প্রায় দুই ঘণ্টা বন্ধ ছিল।

কিন্তু চালক, শ্রমিকরা আগের মতো যেখানে-সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামার সুযোগ চান। তাদের ভাষ্য, এ সুযোগ না থাকায় আয় কমে গেছে। কাউন্টার মেনে চললে বেতন বাড়াতে হবে। এ দাবিতে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে শ্রমিকরা সায়েদাবাদ এলাকায় জড়ো হন।

বাড্ডা এলাকায় জাহাঙ্গীর হোসেন নামের এক যাত্রী বলেন, প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আগে প্রতি ৫ মিনিট পরপর গাড়ি পাওয়া যেত। কিন্তু এখন শ্রমিকদের অবরোধের জন্য বাস পাওয়া যাচ্ছে না। কয়দিন পরপর এসব ঝামেলার জন্য আমাদের মতো যাত্রীরা জিম্মি হয়ে থাকি। এগুলো দেখার কেউ নেই।

পরিবহন শ্রমিকরা দাবি করছেন, নতুন টিকিট পদ্ধতিতে তাদের ক্ষতি হচ্ছে। তাদের ইনকাম কমে গেছে। এ সার্ভিসের কারণে তেলের টাকা উঠছে না বলে জানান শ্রমিকরা। রোববার রাতেই পরিবহন মালিক সমিতির সঙ্গে এ নিয়ে মিটিং হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার বিষয়ে সিদ্ধান্তও হয়। তবে আশানুরূপ সমাধান না হওয়ায় পরিবহন শ্রমিকরা গাড়ি চালাচ্ছেন না।

তুরাগ পরিবহনের বাসচালক হোসেন আলী বলেন, সারা দিন গাড়ি চালিয়ে রাত ২টায় যেতে হয় টাকা আনতে কাউন্টারে। সেখানে গিয়ে টাকার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। আগে যে টাকা পেতাম তার থেকে কম নিতে হচ্ছে। এইভাবে চললে আমাদের সংসার চলবে কীভাবে। আমরা নতুন নিয়মে গাড়ি চালাতে চাই না। রাইদা পরিবহনের চালক রুহুল বলেন, গাড়ি চালিয়ে সংসার চালানোর মতো টাকাই যদি দিন শেষে না পাই, তাহলে এই সিস্টেমে চালিয়ে আমাদের লাভটা কী?

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, যানজট নিরসন ও পরিবহন খাতে নৈরাজ্য রোধে যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামার সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। নিয়ম মেনেই চলতে হবে।

উল্লেখ্য, গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর তিনটি রুটের বাসে ই-টিকিটিং ও কাউন্টার পদ্ধতি চালু করা হয়। এ পদ্ধতিতে গোলাপি রঙের বাস কাউন্টার থেকে শুধু টিকিটধারী যাত্রীকে তুলবে। সড়ক পরিবহন আইনেও যত্রতত্র যাত্রী তোলা নিষিদ্ধ। এ নিয়ম ভঙ্গের সাজা হিসেবে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা ছয় মাসে কারাদ- রয়েছে।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঢাকার আবদুল্লাহপুর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচল করা ২১টি কোম্পানির বাস একক কোম্পানির অধীন পরিচালনা করার উদ্যোগ নিয়েছেন তারা। এর আওতায় প্রায় ২ হাজার ৬১০টি বাস চলাচল করবে। বাসগুলোর রং হবে গোলাপি।

সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এসব বাস চলবে কাউন্টার পদ্ধতিতে। যাত্রীদের নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করে বাসে যাতায়াত করতে হবে। নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া বাস দাঁড় করানো হবে না। যাত্রী ওঠানামাও করবে নির্দিষ্ট স্থানে। বাসে ওঠানামার জন্য ঢাকার বিভিন্ন অংশে থাকবে প্রায় ১০০টি স্টপেজ। তবে সব স্টপেজে কাউন্টার বসানোর কাজ এখনো শেষ হয়নি।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পরিবহন সেক্টরের উন্নয়নে যেকোনো সিদ্ধান্ত মালিকদের পাশাপাশি যাত্রী ও শ্রমিকদের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। এত সব সমস্যা সামনে তুলে আনার সুযোগ থাকে। যে সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে নেয়া হয়েছে তা একপেশে। পরিবহনের সঠিক ব্যবস্থাপনা না করে, হুটহাট একের পর এক নিয়মে গাড়ি চালালে সমস্যা তো হবেই। আর এই সমস্যার জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যাত্রীরা। তিনি বলেন, নতুন নিয়মে পরিবহন শ্রমিকরা আগের মতো টাকা পাচ্ছেন না। তাদের বিষয়গুলো সমাধান হওয়া উচিত।

মিটারের বেশি ভাড়া নিলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা : সিএনজি বা পেট্রলচালিত অটোরিকশার চালক মিটারের বেশি ভাড়া আদায় করলে তার বিরুদ্ধে মামলা দিতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সড়ক পরিবহন আইনে ভাড়াসংক্রান্ত অপরাধে চালকের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।

মঙ্গলবার বিআরটিএর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশু শেখর বিশ্বাসের সই করা এক চিঠি থেকে বিষয়টি জানা যায়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনারকে চিঠিটি দেওয়া হয়েছে।

ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, গ্যাস বা পেট্রলচালিত ফোর-স্ট্রোক থ্রি-হুইলার অটোরিকশার জন্য সরকার নির্ধারিত মিটারের ভাড়ার হারের অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে মামলা রুজু করার নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

আরও বলা হয়েছে, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮–এর ধারা ৩৫(৩) অনুযায়ী কোনো কন্ট্রাক্ট ক্যারিজের মালিক বা চালক রুট পারমিট এলাকার মধ্যে যেকোনো গন্তব্যে যেতে বাধ্য থাকবেন এবং মিটারে প্রদর্শিত ভাড়ার অতিরিক্ত অর্থ দাবি বা আদায় করতে পারবেন না। এর ব্যত্যয় হলে আইনের ধারা ৮১ অনুযায়ী অনধিক ছয় মাসের কারাদ- বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষসূচক ১ পয়েন্ট কর্তন করার বিধান রয়েছে।

বর্তমানে অটোরিকশার মালিকের জন্য দৈনিক জমা নির্ধারিত আছে ৯০০ টাকা। তবে চালকেরা বলছেন, মালিকেরা দিনে দুই বেলায় চালকের কাছে অটোরিকশা ভাড়া দিয়ে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন।

ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে চলাচলকারী প্রায় ২৮ হাজার অটোরিকশার জন্য পৃথক নীতিমালা রয়েছে। এসব অটোরিকশাকে কন্ট্রাক্ট ক্যারিজ বা ভাড়ায় চালিত যান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নীতিমালা অনুসারে, সিএনজি ও পেট্রলচালিত অটোরিকশার ভাড়া ও মালিকের দৈনিক জমা নির্ধারিত রয়েছে।

বর্তমানে অটোরিকশার মালিকের জন্য দৈনিক জমা নির্ধারিত আছে ৯০০ টাকা। তবে চালকেরা বলছেন, মালিকেরা দিনে দুই বেলায় চালকের কাছে অটোরিকশা ভাড়া দিয়ে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন।

অটোরিকশার বর্তমান সর্বনি¤œ (প্রথম দুই কিলোমিটার) ভাড়া ৪০ টাকা; অর্থাৎ একজন যাত্রী চাইলে ৪০ টাকায় অটোরিকশা ভাড়া করার সুযোগ পাবেন। যাত্রীদের অভিযোগ, ১৫০ টাকার নিচে স্বল্প দূরত্বে যাতায়াত করা যায় না। দুই কিলোমিটারের পরের প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ১২ টাকা নির্ধারিত থাকলেও তা কেউ মানেন না।

২০০৩ সালের দিকে রাজধানী ঢাকা ও বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে বেবিট্যাক্সি তুলে দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালু করে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার। মিটারে নির্ধারিত ভাড়া ও যাত্রীদের চাহিদামতো গন্তব্যে চলাচল করতে বাধ্য থাকবে, এই ছিল মূল শর্ত। কিন্তু নগরবাসী বলছেন, কখনোই শর্তগুলো মানা হয়নি। ভাড়া নির্ধারিত হয় চালকের ইচ্ছেমতো। নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে চাইলে অনেক ক্ষেত্রেই চালকেরা অনীহা দেখান।

সিএনজিচালিত অটোরিকশার নীতিমালা অনুসারে, মালিকেরা অটোরিকশা কিনে চালকদের চালাতে দেবেন। বিনিময়ে সরকার নির্ধারিত হারে দৈনিক জমা পাবেন তাঁরা। আর চালকেরা মিটারে নির্ধারিত ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করবেন।