জাতীয়
ফ্যাসিস্ট আ’লীগ শাসনকালে
ভারতের সাথে ৮৬ অসম গোপন চুক্তি প্রকাশ ও বাতিল দাবি
ভারত চাণক্য নীতিতে চলে বা ভারতের পররাষ্ট্রনীতি চাণক্যকে অনুসরণ করে- এটা দেশের মানুষের মুখে শোনা বহুল প্রচলিত কথা। বাংলাদেশের পতিত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ১৯৭৫ সাল থেকে ছয় বছরের মতো ভারতেই কাটিয়েছেন।
Printed Edition
মুহাম্মদ নূরে আলম: ভারত চাণক্য নীতিতে চলে বা ভারতের পররাষ্ট্রনীতি চাণক্যকে অনুসরণ করে- এটা দেশের মানুষের মুখে শোনা বহুল প্রচলিত কথা। বাংলাদেশের পতিত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ১৯৭৫ সাল থেকে ছয় বছরের মতো ভারতেই কাটিয়েছেন। এখনও তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন ভারতেই। জুলাই বিপ্লবে গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা দিল্লিতে আশ্রয় নেয়ার পর দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে ভারতে একটা অস্বস্তির জায়গা তৈরি হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ এক দশকের অনির্বাচিত আওয়ামী সরকার ও স্বৈরশাসনে ছিল বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্য বিস্তারের প্রধান অবলম্বন। বাংলাদেশে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে প্রতিবেশী দেশ ভারত নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে। ট্রানজিট, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসম ৮৬টি চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে তারা এই আধিপত্য সৃষ্টি করেছে। তাদের সেই আধিপত্য রুখতে সব কটি চুক্তি সরকারকে প্রকাশ করতে হবে ও দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তিগুলো বাতিল করতে হবে বলে বারবার দাবি উঠেছে ছাত্র-জনতার পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এবং বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় তথ্য বাতায়নের সূত্রে এইসব তথ্য জানাযায়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন পাওয়া গেলেও সরকারি ওয়েবসাইট কিংবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত বিশদ তথ্য পাওয়া যায় না।
এদিকে প্রাচীন হিন্দু রাজা ও শাসকদের চাণক্যের বহুল আলোচিত চারটি নসিহতের মধ্যে দুটি হলো: সকল সীমান্তবর্তী রাজ্যকে শত্রু মনে করতে হবে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহকে বাদ দিয়ে অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে হবে। বর্তমান ভারত ও ভারতীয় সরকার চাণক্যের এই নীতিতে বিশ্বাসী। এই থিওরি মোতাবেক তারা উপমহাদেশের অন্যান্য রাষ্ট্রকে নানাভাবে অসুবিধায় ফেলে সুবিধা নিতে সদা তৎপর। এছাড়াও ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ‘আধিপত্যবিরোধী ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে আয়োজিত মশাল মিছিল পূর্ববর্তী সমাবেশে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সব চুক্তি জনসম্মুখে প্রকাশের দাবি জানায় একদল শিক্ষার্থী।
নিজের স্বার্থে আওয়ামী লীগ প্রথম ভারতের সাথে গোপন গোলামির চুক্তি করে: পতিত স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে এই প্রভাব অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছিল সমালোচকদের কাছে। এই সময়টায় দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক নিয়ে বিভিন্ন মহলে কথা উঠেছে। এসব চুক্তি বা সমঝোতা স্মারকে ভারতের অতিলাভের বিপরীতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি শূন্য বলেই মনে হয়েছে পর্যবেক্ষকদের কাছে। এমনকি ২০১৮ সালের মে মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা ‘ভারতকে যা দিয়েছি সারা জীবন মনে রাখবে’ মন্তব্য করলে চুক্তি-সমঝোতা স্মারকের স্বচ্ছতা নিয়ে জোর আলোচনা ওঠে। যদিও ফ্যাসিস্ট হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে এ নিয়ে সমালোচনার সাহস হয়নি বিশ্লেষকদের। কেবল বিরোধী রাজনীতিকরা চুক্তিগুলোর বিস্তারিত প্রকাশের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি বা সাত দফা গোপন চুক্তি হলো মুজিবনগর সরকার ও ভারত সরকার মধ্যকার একটি কথিত গোপন মৈত্রী চুক্তি। বলা হয়ে থাকে গোপন চুক্তিপত্রটি ১৯৭২ সালে ২৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল এবং কথিত গোপন চুক্তিটিতে ৭টি শর্ত ছিল। চুক্তি সম্পর্কে দুটি বয়ান প্রচলিত আছে। ইংরেজী ভাষায় প্রণীত এই চুক্তির শিরোনাম ‘‘ঞযব ওহফড়-ইধহমষধ ঞৎবধঃু ড়ভ ঋৎরবহফংযরঢ়, ঈড়ড়ঢ়বৎধঃরড়হ ধহফ চবধপব’’ যার অনুবাদ ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তি। বাংলাদেশের পক্ষে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। সূত্র মতে, ২০১০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ২০টি চুক্তি হয়েছে। আর সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে ৬৭টি। এসব ছিল ট্রানজিট, যোগাযোগ, বন্দর, বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতা শুধু পরররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হয়নি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও হয়েছে। এসব মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান চাইলে তাদের চুক্তি -সমঝোতা পর্যালোচনা ও পুনর্বিবেচনা করতে পারে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়েছে, সেসব বাতিল করা সম্ভব কি না জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, দুই দেশের সঙ্গে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়েছে, সেখানে অসামাঞ্জস্যতা রয়েছে কি না, সেসব পর্যালোচনার জন্য খুব ভালোভাবে হোম ওয়ার্ক করতে হবে। তাহলেই বলা যাবে, চুক্তি ও সমঝোতায় কোন কোন ধারায় অসামাঞ্জস্য রয়েছে, বা আমাদের আপত্তিগুলো কোথায়। তবে সেটি করার জন্য কোনো কমিটি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যদি মনে হয়, কোনো অসম চুক্তি বা সমঝোতা হয়েছে, তাহলে উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনার সুযোগ আছে।
ভারতের সঙ্গে চুক্তি বাতিল বা পর্যালোচনার বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন একাধিকবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে, সবতো আর আমাদের মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হয় না, সেখানে কিছু গোপনীয় আছে কি না আমার জানা নেই। তবে, বাই অ্যান্ড লার্জ যে চুক্তি হয়ে থাকে, সেগুলো কিন্তু ওপেন (প্রকাশিত)। এখানে গোপনীয় কিছু নেই। তবে অসামাঞ্জস্য চুক্তির কথা যদি বলেন, আপনি দরকষাকষি যদি করেন, সেটা করবেন চুক্তির আগে। চুক্তির পরে নয়। আর চুক্তির পর পর্যালোচনা করতে চাইলে সেটা দুই পক্ষ মিলেই করতে হবে। এক তরফাভাবে বাতিল করতে পারবেন না।
আলোচনায় আদানিসহ যত অসম চুক্তি: ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে আদানি গ্রুপকে বাড়তি সুবিধা দেয়া, বেশি খরচ, ক্যাপাসিটি চার্জের মতো দিকগুলোও দেশের স্বার্থবিরোধী হিসেবে দেখেন অনেকে। এছাড়া রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়েও ছিল সমালোচনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ আদানি গ্রুপের সঙ্গে অদ্ভুত বিদ্যুৎ সরবরাহ চুক্তি(২৫ বছর মেয়াদী চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে আমদানি করা কয়লা ব্যবহার হবে। কিন্তু যে পদ্ধতিতে কয়লা আমদানি করা হবে তাতে আমদানি খরচ বেশি দেখানোর সুযোগ রয়েছে। এতে আদানির মুনাফা বৃদ্ধির বিশেষ সুযোগ রয়েছে), রেল ট্রানজিট সংক্রান্ত চুক্তি (যাতে ভারতের ট্রেন বাংলাদেশের দর্শনা দিয়ে প্রবেশ করে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি সীমান্ত দিয়ে ফের ভারতে যেতে পারে), ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮১ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম শহরে সরবরাহে সমঝোতা, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে ভারত থেকে এবং ভারতে পণ্য আনা-নেওয়ায় স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম (এসওপি) স্বাক্ষর ইত্যাদি দেশের মানুষের মনে নানা সন্দেহ-সংশয় তৈরি করেছে। এসব চুক্তিতে বাংলাদেশের লাভ কোথায় এমন প্রশ্ন যেমন এসেছে, তেমনি প্রকাশ হয়েছে দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগও।
রেল ট্রানজিট চুক্তি নিয়ে গত বছরের জুনেই এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, চুক্তি ও সমঝোতার নামে এদেশের প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে ভারতের জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার অংশে পরিণত করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য খুবই বিপজ্জনক। তিনি আরও বলেন, একতরফাভাবে ভারতকে করিডোর সুবিধা দেয়ার জন্য এ চুক্তি করা হয়েছে। এ ট্রেন বাংলাদেশের কোনও মানুষ ব্যবহার করতে পারবে না। এতে বাংলাদেশের কোনো লাভও হবে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বুদ্ধিজীবী আনু মুহাম্মদ বলেন, শেখ হাসিনার সরকার শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পণ করেছে। একের পর এক চুক্তি করেছে। এর প্রধান কারণ ছিল নির্বাচন ছাড়া চিরস্থায়ী ক্ষমতা তৈরি করা। সে কারণে তার পুরো নির্ভরশীলতা তৈরি হয় ভারত রাষ্ট্রের ওপরে। তাই দেশের জন্য ক্ষতিকর সে চুক্তিগুলো বাতিল করা সরকারের প্রথম দায়িত্ব। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচার সরকারের সঙ্গে ভারতের সব গোপন চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজ আইডিতে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি তিনি এই দাবি জানান।
সীমান্তে ভারতের সাথে যে গোপন চার চুক্তি করে হাসিনা সরকার: বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চার হাজার ১৫৬ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকার মধ্যে তিন হাজার ২৭১ কিলোমিটার এলাকাতেই ভারত অবৈধভাবে কাঁটাতারের বেড়া তৈরির কাজ শেষ করেছে। ভারত অত্যন্ত গোপনে ২০১০ সালে শুরু করে ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এ বেড়া নির্মাণের কাজ করে। ২০১০ সালের পর বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বিদ্যমান চার হাজার ১৫৬ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে তিন হাজার ২৭১ কিলোমিটার এলাকায় ভারত সব নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে। এখন বাকি ৮৮৫ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণে ভারত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা এটা কোনোভাবে করতে দেব না। প্রতিনিয়ত প্রতিটি এলাকা আমরা নজরদারিতে রেখেছি বলে জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ভারতের সাথে বাংলাদেশের অন্তত ২০ টি চুক্তি ও ৬৬ টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সহযোগিতা এবং আগের চুক্তির পরিসরও বাড়ানো হয়েছিল এ সময়ে। এছাড়া সমঝোতা স্মারক পরবর্তীতে চুক্তিতে রূপান্তর হয়েছিল কী-না, সেটাও পরিষ্কার জানা যায় না। যেমন চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার নিয়ে ২০১৫ সালে একটি সমঝোতা স্মারক থাকলেও, এ নিয়ে ২০১৮ সালে হওয়া চূড়ান্ত চুক্তির নথি বা তথ্য সরকারিভাবে কোথাও নেই। সম্প্রতি বাংলাদেশের মোংলা বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব ভারত পেয়েছে -এমন খবর চীন ও ভারতের গণমাধ্যম থেকেই এসেছে। বাংলাদেশে কর্তৃপক্ষের তরফে এর বিস্তারিত জানানো হয়নি। এসব নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নানা সময়ে সরকার তথা আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে এসেছে।