DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

জাতীয়

নেপথ্যে কলকাঠি নাড়াচ্ছে কারা?

ডাকাতি-ছিনতাইসহ ভয়ঙ্কর অপরাধে বাড়ছে আতঙ্ক

নাছির উদ্দিন শোয়েব
Printed Edition

হঠাৎ ছিনতাই-ডাকাতি আতঙ্ক বেড়েছে মানুষের মাঝে। অবস্থা এমনই যে টাকা বা মূল্যবান জিনিস নিয়ে এখন চলাফেরা করতেই ভয় পাচ্ছে মানুষ। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ডাকাতির ভয়। বড় অংকের টাকা পরিবহনেও ঝুঁকি মনে করছে। পাড়া-মহল্লায় ডাকাত আতঙ্ক। বাসা-বাড়িতেও নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করছে বাসিন্দারা। কোথাও কোথাও ডাকাত সন্দেহে মসজিদে মাইকিংও করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও মসজিদের মাইকে মাইকিং করে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। ছিনতাইকারী সন্দেহে ধরে গণপিটুনিও দেয়ার ঘটনাও ঘটছে।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে যৌথবাহিনীর তৎপরতা এবং ডেভিল হান্ট নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যেও অপরাধীরা এতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে কিভাবে? পুলিশ ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে থেকে জানা গেছে- সম্প্রতি বিভিন্নস্থানে যেসব অপরাধমূলক কর্মকা- ঘটছে এর নেপথ্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের হাত রয়েছে। ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইসহ অপরাধ বেড়ে গিয়েছিল। এরপর কিছুদিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু গত দুই সপ্তাহ ধরে আবারও অপরাধমূলক কর্মকা- বেড়ে যায়। মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাসেও ঘটছে ডাকাতি ও শ্লীলতাহানির মতো ঘটনা। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে বিশ্লেষকরা বলছেন- যেসব ঘটনা ঘটছে তা কোনো অবস্থাতেই স্বাভাবিক বলা যায় না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে নেপথ্যে কোনো মহল কলকাঠি নাড়াচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করতে পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। যা ঘটছে তার চেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে।

একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ভবন ভেঙে ফেলার পর ভারতে পলাতক স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার একটি অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়। এতে বলতে শোনা গেছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কয়েকজনকে অডিও বার্তায় শেখ হাসিনা বলছেন ‘যারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে হামলা-ভাংচুর চালিয়েছে তাদেরকে এমনভাবে উচিত শিক্ষা দিতে হেবে যেনো তারা সারাজীবন মনে রাখে। হুমকি দিয়ে তাকে বলতে শোনা যায় ধানমন্ডিতে যারা ভাংচুর করেছে তাদেরকে খুঁজে খুঁজে চিহ্নিত করে হাত ভেঙে দিতে হবে। যে হাত দিয়ে হামলা চালিয়েছে তাদের সেই হাতে আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা’। ওই অডিও বার্তার এই প্রান্ত থেকে ‘জি-জি বলে শেখ হাসিনার নির্দেশ পালনের প্রতিশ্রুতি দিতেও শোনা গেছে। অন্যদিকে কিছুদিন আগে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের একটি অডিও রেকর্ড ভাইরাল হয়। সেখানে তাকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিতে শোনা যায়। রাজধানীর মানুষ যেন রাতে ঘুমাতে না পারে, সে জন্য তারা টিম রেডি করেছেন বলে ফোন কল রেকর্ডিংয়ে শোনা যায়। তবে অডিও ভয়েসটি যাচাই করা সম্ভব হয়নি। জাহাঙ্গীর আলমের কণ্ঠসদৃশ্য অডিওতে বলতে শোনা যায়, আমাদের টিম রেডি, রাজধানীতে রাতে মানুষ ঘুমাতে পারবে না। কোথা হতে কি করতে হবে, অল্প সময়ের মধ্যে আপনারা মূল ম্যাসেজটা পাইবেন। আমরা প্রমাণ করে দিতে চাই, আমরা কার সৈনিক।’ গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে ভাইরাল হয় ছয় মিনিটের ফোন কলটি। যেখানে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘কয়েকটা মিনিট আমার কথা ধৈর্য ধরে শুনেন। এখানে সম্রাট ভাই আছেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। আমাদের সেভেন্টি থেকে এইট্টি পারসেন্ট টিম আছে। আমাদের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে শৃঙ্খলার মাধ্যমে থাকতে চাই। আমাদের কথা স্পষ্ট, যে রাজধানীতে দিনের বেলা স্বাধীনভাবে আমরা ঘুরতে পারব না, চলতে পারব না; আমাদের চূড়ান্ত ডিসিশন সেই রাজধানীতে রাতের বেলায় মানুষ ঘুমাতে পারবে না।’ তাকে আরো বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের মূল নেত্রী যে ডিসিশন দেবে, পরামর্শ ক্রমে সেটাই করব। আমি আপনাদের অনুরোধ করব, আপনারা আমাদের চূড়ান্ত খেলার মধ্যে, সিদ্ধান্তের মধ্যে যে যেখানে যে অবস্থায় থাকবেন পরিবার ও শুভাকাক্সক্ষীদের নিয়ে রাতে আসবেন। মরলে সবাই মরি, বাঁচলে সবাই বাঁচি।

ছড়ানো হচ্ছে মিথ্যা তথ্য : বুধবার বিকেলে ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আগানগর এলাকায় সিমা বেগম নামে ৪০ বছরের এক নারী ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। পরবর্তীতে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে এটি ছিনতাইয়ের ঘটনা নয়। নিহতের স্বামী আক্তার হোসেন বলছেন, তার স্ত্রী ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে পুলিশ দাবি করছে, পরকীয়ার জেরে এই হত্যাকা- ঘটেছে। ইতোমধ্যে ঘটনায় জড়িত ইমাম হোসেনকে (২০) আটক করেছে কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ। মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে গুরুতর আহত অবস্থায় সীমা নামে ওই নারীকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হয়। স্থানীয়রা দাবি করছেন, নিহত সিমা বেগম ও আটক ইমাম হোসেনের মধ্যে পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। প্রেমিক ইমাম কেরানীগঞ্জের আগানগরের আমবাগিচা বৌ বাজার এলাকায় ভাড়া থাকেন। তার প্রেমিকা সীমা আক্তার আগানগর ছোট মসজিদ এলাকায় ভাড়া থাকেন। পরকীয়া সম্পর্কের জের ধরে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সীমা ইমামের ভাড়া বাড়িতে দেখা করতে আসেন। এ সময় তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে ইমাম সীমাকে কুপিয়ে জখম করে। তখন সীমা চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন ইমামকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। এ বিষয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘সিমা আক্তার হত্যাকা-ের ঘটনাটি ছিনতাইয়ের ঘটনা নয়।

মসজিদে মাইকিং আতঙ্ক : গত রোববার রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডির শংকর এলাকায় ১০ থেকে ১২ জনের সশস্ত্র একটি দলের মহড়ায় এলাকায় আতঙ্ক ছড়ায়। এসময়, ‘ছুরি-চাপাতি নিয়ে ডাকাতদল প্রবেশ করেছে, আমরা সবাই সতর্ক থাকি’ বলে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়। শংকর আলী হোসেন বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে ১০ থেকে ১২ জনের একদল সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দলটি আশপাশের দোকানিদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছিল। আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা দ্রুত দোকান বন্ধ করে দেন এবং সাধারণ মানুষ নিরাপদ স্থানে চলে যান। ৫-১০ মিনিট অবস্থান করার পর সশস্ত্র দলটি সেখান থেকে চলে যায়। ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে স্থানীয়রা মসজিদের মাইকে সতর্কতা প্রচার করেন, যা সামাজিক মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থলে গিয়ে তারা কাউকে পায়নি। কিশোর গ্যাং মহড়া দিচ্ছিলো। এলাকাবাসী ডাকাত ভেবে মাইকে ঘোষণা দিলে তারা পালিয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে দুষ্কৃতকারীদের পরিচয় জানা যায়নি এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছে পুলিশ।

পুলিশ দেখে আসামীদের মাইকিং : দোহার থানা পুলিশ জানায়, গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাত ১২.৪০ মিনিটে ঢাকা জেলার দোহার উপজেলাধীন বিলাশপুর ইউনিয়নে কুতুবপুর গ্রামে আওয়ামী লীগের ৭ নং ওয়ার্ড সভাপতি মোঃ হযরত মোল্লাকে পুলিশ গ্রেফতার করতে গেলে আসামীর আত্মীয় স্বজন এলাকায় ডাকাত পড়েছে বলে মসজিদের মাইকে ভুয়া সংবাদ ঘোষণা করতে থাকে। পরবর্তীতে উক্ত ঘোষণার সংবাদ পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের মসজিদেও সংবাদটি প্রচার করা হয়। যার ফলে জনমনে আতংকের সৃষ্টি হয়। ঘটনাস্থল হতে মোঃ হযরত মোল্লা ও কুতুবপুর মোহাম্মাদিয়া জামে মসজিদের ইমাম মোঃ মোজাম্মেল হককে দোহার থানা পুলিশ গ্রেফতার করে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন দোহার থানা ওসি রেজাউল করিম। এরআগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় স্থানীয় কিছু ব্যক্তি তাদের কয়েকজনকে আটক করে মারধর করেন, এ ঘটনায় আহত একজন পরে হাসপাতালে মারা যায়। এলাকাবাসী ও পুলিশ জানিয়েছে, সেদিন রাত ৯টার দিকে একদল বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা গাজীপুর মহানগরের ধীরাশ্রমের দক্ষিণখানে মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা চালানোর সময় মসজিদের মাইকে মন্ত্রীর বাড়িতে ডাকাত পড়েছে বলে ঘোষণা দিয়ে লোকজনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। মাইকিং শুনে আশপাশের লোকজন বাড়িটি ঘিরে ফেলেন।

বিশ্লেষক ও পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শক্তভাবে বিশৃঙ্খলা ও অপরাধ দমন করতে পারছে না। এতে অপরাধীরা মনে করছে, তারা পার পেয়ে যাবে। আর এ সুযোগে পতিত সরকারের দল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ঘাপটি মারা নেতা-কর্মীরা অস্ত্র হাতে মাঠে নেমে অপরাধমূলক কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) থানা পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অভিযানে গেলে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তখন বল প্রয়োগ করা হলে ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা থাকে। এ কারণে পুলিশকে অপরাধীরা এখন আর সেভাবে ভয় পাচ্ছে না। এ কারণেই তারা বেপরোয়া।

টহল কার্যক্রম হঠাৎ পরিদর্শনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা : মহানগর এলাকায় জননিরাপত্তা বিধান তথা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে পুলিশের টহল কার্যক্রম আকস্মিক পরিদর্শন করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। গতকাল বুধবার ভোরের দিকে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ও মোড়ে স্থাপিত পুলিশসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত চেকপোস্ট ও তল্লাশি চৌকির কার্যক্রম ও কয়েকটি থানা ঘুরে দেখেন তিনি। বারিধারায় ডিওএইচএসের বাসা থেকে বের হয়ে বনানী মোড়, বিজয় সরণি (নভোথিয়েটার), মানিক মিয়া এভিনিউ, কলাবাগান, ইডেন কলেজ হয়ে নিউমার্কেট থানা পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। পরবর্তী সময় নিউমার্কেট থানা থেকে শাহবাগ মোড়, মৎস্য ভবন, মগবাজার, হাতিরঝিল, পুলিশ প্লাজা হয়ে গুলশান থানা ঘুরে দেখেন তিনি। পরিদর্শন শেষে গুলশান থানা থেকে ইউনাইটেড হাসপাতাল হয়ে বারিধারার বাসায় ফেরত আসেন। পথিমধ্যে তিনি আশপাশের কিছু অলিগলিও ঘুরে দেখেন। পরিদর্শনকালে উপদেষ্টা থানা ও চেকপোস্টে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন ও তাদেরকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেন। তিনি রাজধানীসহ সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকারও নির্দেশনা দেন।

বিষয়সমূহ