জাতীয়
প্রতিরোধ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম
পিলখানায় সেদিন হাজার হাজার জওয়ান হত্যাকান্ডের পক্ষে, তারা খুঁজে খুঁজে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করেছে নৃশংসভাবে। ওই অবস্থায় কোনো কোনো বিডিআর সদস্য হয়তো এ হত্যাকান্ডের সমর্থন করেননি, কিন্তু কেউ এর প্রতিবাদও করেননি।
Printed Edition

পিলখানায় সেদিন হাজার হাজার জওয়ান হত্যাকান্ডের পক্ষে, তারা খুঁজে খুঁজে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করেছে নৃশংসভাবে। ওই অবস্থায় কোনো কোনো বিডিআর সদস্য হয়তো এ হত্যাকান্ডের সমর্থন করেননি, কিন্তু কেউ এর প্রতিবাদও করেননি। তার মধ্যেও একজন ছিলেন ব্যতিক্রম, তিনি হলেন বিডিআর এর তৎকালীন কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম। তিনি এ হত্যাকান্ডের প্রতিরোধ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরের মর্যাদা দিয়েছে।
জানা গেছে, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী পিলখানায় দরবারে যোগ দিতে দেরি হয়ে যাবে- এই আশঙ্কায় নুরুল ইসলাম সকালে নাশতা না খেয়েই বাসা থেকে বের হয়ে যান। সে দিন তার ছেলে মো: আশরাফুল আলম হান্নানের পরীক্ষা ছিলো। বাবা খাবার খেয়ে পরীক্ষা দিতে যেতে বলেছিলো, কিন্তু দেরি হয়ে যাবে বলে নিজে না খেয়ে দরবারে চলে যান। যাওয়ার ৭ দিন পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে বাবার মৃতদেহ গ্রহণ করেন তিনি। আশরাফুল আলম হান্নান বলেন, এই ৭ দিনে এমন কোন হাসপাতাল নেই বা যে যেখানে বলেছে সেখানেই আমরা বাবাকে খুঁজেছি, কেউই বলেনি বাবাকেও মেরে ফেলা হয়েছে। নুরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল আলম বলেন, ২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিহত অন্যান্যের মত তার বাবার লাশ গণকবর থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়। পরে ঐ বছরের ৪ মার্চ লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরলক্ষ্মী গ্রামের বাড়িতে তার বাবার লাশ দাফন করা হয়। হান্নান বলেন, বাবা ছিলেন খুবই পরহেজগার মানুষ, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তেন ও কুরআন তেলাওয়াত করতেন নিয়মিত। প্রতি শুক্রবার দাড়ি ও চুলে মেহেদি লাগাতেন। ২৫ ফেব্রুয়ারী নির্মম ঘটনায় নিহত নুরুল ইসলাম রেখে গেছেন স্ত্রী, তিন কন্যা ও এক পুত্র।
দরবার হলে জওয়ানেরা হত্যাকান্ড শুরু করার পর অনেকে যেখানে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছিলেন, সেখানে সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম এগিয়ে যান সশস্ত্র জওয়ানদের প্রতিরোধ করতে। হত্যাকান্ডের বাধা দেওয়ায় হত্যাকারীরা মশারি টাঙানোর লোহার স্ট্যান্ড দিয়ে পিটিয়ে তারপর ব্রাশফায়ার করে নৃশংসভাবে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধা এই বিডিআর এর সুবেদার মেজরকে। বিডিআর সদর দপ্তরে সুবেদার মেজর হিসেবে তিনি ছিলেন বিডিআর এর প্রতিনিধি। মহাপরিচালকের সাঙ্গে তার ছিল সরাসরি দাপ্তরিক সম্পর্ক। সেদিন ঘটনার শুরুর মুহূর্তে মহাপরিচালকের নির্দেশে তিনি মাইকযোগে জওয়ানদের শান্ত হতে বার বার বিভিন্নভাবে অনুরোধ জানান, এগিয়ে যান সশস্ত্র জওয়ানদের প্রতিরোধ করতে, হত্যাকান্ডে বাধা দেওয়ায় পরে ৪ জন বিডিআর সদস্য তার কাছ থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে লোহার স্ট্যান্ড দিয়ে পিটিয়ে, পেটে ক্ষতবিক্ষত করে, পরে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে গণকবরে রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে তদন্তে বেরিয়ে আসে নুরুল ইসলামের এই বীরত্বের কথা। এ হত্যাকান্ডের ছয় মাস পর একমাত্র বিডিআর সদস্য সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা পান এবং পরবর্তিতে বিজিবির সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ পদকে ভূষিত করা।
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংঘটিত পিলখানা হত্যাকান্ডের সময় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতি অবিচল আস্থা, প্রশ্নাতীত আনুগত্য এবং অতি উন্নতমানের সৈনিকসুলভ আচরণ প্রদর্শন করে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে হত্যাকারীদের বর্বরোচিত কাজে বাধা প্রদান করায় হত্যাকারীরা তাকে নৃসংশভাবে হত্যা করে গণকবরে নিক্ষেপ করে।
কর্মজীবনে তিনি চারবার ডিজি পদক পেয়েছেন এবং অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য সরকার তাকে পবিত্র হজ¦ব্রত পালন করান। নুরুল ইসলাম চাকরিজীবনে একজন সৎ মানুষ হিসেবে সবার শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। তিনি শ্রেষ্ঠ বিওপি কমান্ডার ও শ্রেষ্ঠ কোম্পানি কমান্ডার এর স্বীকৃতি লাভ করেন। চোরাচালান রোধে তিনি পেয়েছেন বিশেষ পুরস্কার। রাইফেলস ট্রেনিং সেন্টার প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ আট বছর। ২০০১ সালে পাদুয়া যুদ্ধে সংগ্রাম ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার ছিলেন নুরুল ইসলাম।
আশরাফুল আলম বলেন, সেদিন দরবার হলসহ পিলখানায় ৯হাজার এর অধিক বিডিআর সদস্য উপস্থিত ছিলো এবং সারা দেশে ৫০ হাজার এর অধিক বিডিআর সদস্য উপস্থিত থাকলেও কেউই এ হত্যাকান্ড এবং ১২০ এর অধিক আফিসারের জীবন রক্ষার্থে আমার বাবার মত ভূমিকা পালন করে শাহাদাৎ বরণ করেনি। একমাত্র আমার বাবাই হত্যাকারীদের হত্যাকান্ড থেকে বিরত রাখা এবং শহীদগণকে বাঁচাতে গিয়ে বীরের মত জীবন দিয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের বর্বরোচিত হত্যাকান্ড এবং নৃশংসতা একমাত্র বাধাদানকারী এবং ১২০ এর অধিক সেনা আফিসারের জীবন রক্ষার চেষ্টাকারী শহীদ হিসেবে আমার বাবাকে বীরত্বসূচক রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধসহ আবেদন করছি।
তিনি সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনার প্রকৃত কুশীলব এবং প্রকৃত হত্যাকারী ও অপরাধীদের বিচারের বাস্তবায়ন করা, শহীদ সেনা দিবস ঘোষণা, শহীদদের মূল্যায়ন ও পরিবারকে সম্মান প্রদানের দাবী জানান।