জাতীয়
মাতৃভাষা বাংলাভাষা খোদার সেরা দান
ফেব্রুয়ারি মাসের দশম দিবস আজ সোমবার। ১৯৫২ সালে এ সময়টিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠেছিলো সা¤্রাজ্যবাদী স্বৈরশাসক বিরোধী আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ।
ফেব্রুয়ারি মাসের দশম দিবস আজ সোমবার। ১৯৫২ সালে এ সময়টিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠেছিলো সা¤্রাজ্যবাদী স্বৈরশাসক বিরোধী আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে গোটা জনপদ তখন উত্তাল। এ সময় সংবাদপত্রও সভা-সমাবেশের খবর, বিবৃতি ইত্যাদি ছেপে ভাষা-আন্দোলনকে গতিশীল ও ত্বরান্বিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অবশ্য ডেইলি মর্নিং নিউজের মতো পত্রিকাকে নেতিবাচক ভূমিকার কারণে খেসারতও দিতে হয়েছিলো।
ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন তমুদ্দুন মজলিসের নেতৃবৃন্দ সময়ের গুরুত্ব বিবেচনায় ১৯৪৮ সালের ১৪ নবেম্বর থেকে সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ বের করেছিলেন। এতে ভাষা আন্দোলনের খবরাদি ফলাও করে ছাপা হতো। এক সময় ‘সৈনিক’ ছিল ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র। এছাড়াও কোন কোন পত্রিকা সক্রিয়ভাবে আন্দোলন করেছে। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ তমুদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল মিলনায়তনে যে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়েছিল তাতে ‘ইনসাফ’, ‘জিন্দেগী’, ‘দেশের দাবি’ পত্রিকা থেকেও একজন করে প্রতিনিধি নেয়া হয়। ভাষা আন্দোলন যখন একেবারে তুঙ্গে, তীব্রভাবে দাবিটি উত্থাপন করেছে এ দেশের সচেতন মানুষ, তখন বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলী বর্ষিত হয় ছাত্র-জনতার ওপর। এই ঘটনায় জনমনে যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয় তার প্রতিফলন ঘটে পত্রিকাতেও। যে ‘আজাদ’ ভাষা আন্দোলনের বেশির ভাগ সময় সরকারের পক্ষাবলম্বন করেছে, তারই তৎকালীন সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ ত্যাগ করেন। পুলিশের গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে গবর্নর ও স্পীকারের কাছে প্রেরিত পত্রে তিনি জানালেন যে, “নূরুল আমীন সরকারের আমি একজন সমর্থক। এ ব্যাপারে তাহাদের ভূমিকা এতদূর লজ্জাজনক যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এই দলের সহিত যুক্ত থাকিতে এবং পরিষদের সদস্য হিসাবে বহাল থাকিতে আমি লজ্জাবোধ করিতেছি।” পদত্যাগের পরই বিশিষ্ট সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ছাত্রদের নির্মিত শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন।
ভাষা আন্দোলনে মর্নিং নিউজ পত্রিকার ভূমিকা প্রসঙ্গে আব্দুল মতিন ও আহমদ রফিক ‘ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও তাৎপর্য’ গ্রন্থে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘....অবাঙালি স্বার্থের প্রতিনিধি এবং মূলত পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর শ্রেণি স্বার্থের প্রতিনিধি মর্নিং নিউজ ভাষা আন্দোলনের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করা এবং তার চরিত্র হননের জন্য যত ধরনের সম্ভব মিথ্যা, মনগড়া সংবাদ পরিবেশ করেছিল এবং জঘন্য কুৎসামূলক সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখে বাংলা ও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে বিষোদগার করেই কর্তব্য শেষ করেনি, সাম্প্রদায়িকতার উদ্দেশ্যমূলক উস্কানিও দিয়েছে।’
মর্নিং নিউজ পত্রিকার ভূমিকা নিয়ে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদেও আলোচিত হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা বার এসোসিয়েশন হলে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদের সম্মলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘মুসলিম লীগ, লীগ সরকার, আর মর্নিং নিউজ ছাড়া প্রত্যেকেই বাংলা ভাষা চায়।’ রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ মর্নিং নিউজকে বাংলা ভাষা বিরোধী পক্ষ হিসেবে বর্জনের জন্য জনগণকে আহ্বান জানিয়েছে। মর্নিং নিউজের পাশাপাশি দৈনিক সংবাদও সরকারি প্রচারণার দায়িত্ব পালনের চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। এ পত্রিকা দু’টির উদ্দেশ্য ছিল ভাষা আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে জনগণের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা।
এদিকে ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সক্রিয় হয়ে উঠলে ভাষা আন্দোলন আরো গতি পায়। ঢাকায় তখন প্রধান দৈনিক পত্রিকা আজাদ এবং ইংরেজি মর্নিং নিউজ। দুটিই ছিল মুসলিম লীগের সমর্থক সংবাদপত্র। ভাষা আন্দোলন, বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষা করার জন্য ছাত্র প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর (তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমউদ্দীন) চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর দান ইত্যাদি খবর মুসলিম লীগ সমর্থক কাগজগুলোতে ছাপা হয়েছে বৈকি, তেমন গুরুত্ব ও সমর্থন পায়নি। বড় দু’টি দৈনিকের সমর্থন ও সাহায্য না পেলেও ১৯৪৯, ১৯৫০, ১৯৫১ এই তিন বছর ভাষা আন্দোলনকে জিইয়ে রেখেছে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে থেকে প্রকাশিত কয়েকটি সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা।
বস্তুত ভাষা বিতর্কের সূত্রপাত হয় পাকিস্তান সৃষ্টিরও আগে। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক কিছু প্রবন্ধ পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। যথাক্রমে আবুল মনসুর আহমদ ও অলি আহাদ সম্পাদিত ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ তখন ভাষা আন্দোলনের পক্ষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ইত্তেহাদের ‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে ১৯৪৭ সালের ২২ ও ২৯ জুন দুই কিস্তিতে ছাপা হয় লেখক-সাংবাদিক মোহাম্মদ আব্দুল হকের লেখা ‘বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’। ৩০ জুন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় তিনি লেখেন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ নামের আরেকটি প্রবন্ধ। ‘উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে’ নামে এই বিষয়ে আব্দুল হক তৃতীয় প্রবন্ধটি লেখেন ১৯৪৭ সালের ২৭ জুলাই দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায়। সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার ৩ আগস্ট ১৯৪৭ সংখ্যায় চতুর্থ প্রবন্ধটি লেখেন মিসেস এম হক ছদ্মনামে। ভাষা আন্দোলন বিষয়ে তার লেখালেখি নিয়ে মুক্তধারা ১৯৭৬ সালে প্রকাশ করে ‘ভাষা আন্দোলনের আদিপর্ব’ শিরোনামের বই। এ ছাড়া সম্পাদকীয় নীতিতেও ইত্তেহাদ বাংলা ভাষার পক্ষে সোচ্চার ছিল। একই সময়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘আজাদ’ পত্রিকায় শিক্ষার বাহন হিসেবে উর্দু ব্যবহারের প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেন, “ইহা কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও নীতি-বিরোধীই নয়, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন আত্মনিয়ন্ত্রণ ও অধিকারের নীতি বহির্ভূত বটে।” এ ধরনের নিবন্ধ ছাপা হলেও মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত ‘আজাদ’-এর ভাষা প্রশ্নে ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। শুরু থেকেই বাংলা ভাষার ব্যাপারে ইংরেজি দৈনিক ‘মর্নিং নিউজ’-এর ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ নেতিবাচক। মর্নিং নিউজের সাথে সিলেটের ‘আসাম হেরাল্ড’-এর ভূমিকাও ছিল একই সূত্রে গাঁথা। অন্যদিকে, এ পত্রিকাগুলোর প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় সিলেটের সাপ্তাহিক ‘নও-বেলাল’। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন তখনকার প্রগতিশীল যুব নেতা মাহমুদ আলী। এছাড়া ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয় মাসিক সীমান্ত পত্রিকা। এই সীমান্ত পত্রিকার সম্পাদক মাহবুব আলম চৌধুরীই প্রথম ভাষা শহীদদের উপর কবিতা লেখেন, ‘আমি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি, কাঁদতে আসিনি’। তবে ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে প্রকাশিত মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’-এর ভূমিকাও উল্লেখ করার মতো নয়। যদিও ব্যক্তি ভাসানীর ভূমিকা ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা থাকবে।