জাতীয়
ইউনূস সরকারের ৬ মাস
আন্দোলনে স্থবির ঢাকা বেশির ভাগই অযৌক্তিক
কেউ আসছেন বিচার চাইতে, কেউ আসছেন প্রমোশনের জন্য, আবার কেউ এসেছেন চাকরি ফেরত চাইতে। আবার কেউ বা আসছেন ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রায় প্রতিদিনই আন্দোলন চলছে রাজধানী ঢাকাতে।
স্টাফ রিপোর্টার : কেউ আসছেন বিচার চাইতে, কেউ আসছেন প্রমোশনের জন্য, আবার কেউ এসেছেন চাকরি ফেরত চাইতে। আবার কেউ বা আসছেন ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রায় প্রতিদিনই আন্দোলন চলছে রাজধানী ঢাকাতে। এজন্য প্রতিদিন ভোগান্তিতে পড়ছে রাজধানীর কোটি মানুষ। নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি কর্মঘন্টা। কিন্তু সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই কারো। এসব দাবি-দাওয়া নিয়ে কেউ দাঁড়াচ্ছেন শাহবাগে, কেউ কথা বলছেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে, আবার কেউ দাবি নিয়ে ঢুকে যাচ্ছেন প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে। দেখা যাচ্ছে যারা এসব দাবি নিয়ে সামনে আসছেন, তাদের মুখগুলো অপরিচিত। এরমধ্যে দেখা যায় যে, তাদের দাবিগুলো অধিকাংশই অযৌক্তিক।
দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনে রাজধানী ঢাকাসহ প্রশাসনিক কেন্দ্রস্থলগুলোতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষার্থী, শ্রমিক ও বিভিন্ন পেশাজীবীরা রাস্তায় নেমে আসছে, ফলে সাধারণ মানুষের জন্য বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আন্দোলনের কারণে রাজধানীতে যানজট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নানা সংগঠন ও গোষ্ঠীর ব্যানারে যেসব আন্দোলন হচ্ছে যেগুলোর বেশিরভাগই অচেনা। আন্দোলনকারীরা নিজেরা বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার হলে অবরোধ করেন রাস্তা, ঘেরাও করেন অফিস। ১ দিনে ১৭ টি স্পটে অবরোধের ঘটনাও ঘটে।
পরিসংখ্যান বলছে, ড. ইউনুসের অর্ন্তবর্তী সরকারের ৬ মাসে দেড় শতাধিক আন্দোলন হয়েছে; যা স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সময়ে যা কল্পনার মধ্যে আনতে পারেনি কেউ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব আন্দোলন নিয়ে সহীষ্ণু মনোভাব দেখালেও রাজধানী হয়ে পড়ছে স্থবির। মানুষের সহ্যের সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে যানজট পরিস্থিতি।
আন্দোলনের সবশেষ নজির মঙ্গলবার সারাদেশর ট্রেন যোগাযোগই বন্ধ করে দেয় রানিং স্টাফরা। আগের দিন ২৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজেদের দাবিতে সায়েন্সল্যাব মোড় অবরুদ্ধ করে। ফলে পুরো সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয় এবং রাজধানীতে ব্যাপক যানজট দেখা দেয়। একই সময়ে পুরান ঢাকা ও মিরপুরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কেও অবরোধ তৈরি হয়। এতে সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েন। এসব ঘটনার মধ্যে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়, আহত হন অনেকেই। রাত পর্যন্ত চলা এই সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে পথচারী ও সাংবাদিকরাও ছিলেন।
এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন ২৬ জানুয়ারি সকালে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষকরা তাদের দাবির সমর্থনে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নেন। তারা পদযাত্রা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। পুলিশ জলকামান এবং কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে। আন্দোলনকারীরা আবার মঙ্গলবারও শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যান।
এর আগে, ২৪ জানুয়ারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা বেতন স্কেল সংশোধনের দাবিতে শাহবাগে পদযাত্রা শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ তাদের বাধা দেয় এবং তাদের মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে চেষ্টা করে। এরপর, ২৮ জানুয়ারি থেকে রেলওয়ে কর্মীরা কর্মবিরতি শুরু করলে দেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, যা যাত্রীদের জন্য বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করে। এ সময় ক্ষুব্ধ যাত্রীরা রাজশাহী রেলস্টেশনে ভাঙচুর চালান।
এই আন্দোলনগুলো বিশেষ করে ঢাকায় এক নতুন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। আন্দোলনকারীরা তাদের দাবির সমর্থনে রাস্তায় নেমে এলেও, এতে সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন। কিছু আন্দোলন বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহিংসতা সৃষ্টি করেছে, ফলে অনেক পথচারী, সাংবাদিক এবং সাধারণ মানুষ আহত হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই এসব আন্দোলন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিছু মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন, কেন সরকার আলোচনার জন্য এগিয়ে আসেনি, যখন রেলওয়ে কর্মীরা আগেই কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছিলেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার একটি বেসরকারী টেলিভিশনকে জানিয়েছেন, তারা পরিস্থিতি শান্ত রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন এবং পুলিশ মারণাস্ত্র ব্যবহার না করে টিয়ার সেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করেছে। পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে তারা সহিংসতা এড়ানোর জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেছে।
একটি বেসরকারী স্যাটেলাইট টিভির প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীতে ৫ আগস্ট থেকে ১৭৭ দিনে আন্দোলন হয়েছে ১৩৬টি।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ একটি বেসরকারী টেলিভিশনকে বলেন, এতদিন এক পক্ষ সব সুবিধা নিয়ে এসেছে, যারা পাননি তারা বেশিরভাগই আন্দোলনে নেমেছেন। এছাড়া সরকারকে নাজুক ভেবে অনেকেই দ্রুত দাবি আদায়ের চেষ্টায় নেমেছেন।
সচিবালয় ঘেরাও করে ১৯ আগস্টের আন্দোলন ছিল ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় স্থগিত এইচএসসি পরিক্ষাগুলো না দিয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ে ফল প্রকাশের দাবিতে। এর বিপরীতে পরিক্ষা নেয়ার দাবিতেও আন্দোলন হয়। পরে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়েই ফল প্রকাশ হয়। তাতে যারা পাশ করেননি তারাও নামে আন্দোলনে, ঘেরাও করেন শিক্ষাবোর্ড। এই ১৯ আগস্টই রাজধানীর ১৭টি পয়েন্টে চলে নানা দাবিতে অবরোধ, আন্দোলন। কারো দাবি চাকরি স্থায়ীকরণ, কেউ চায়, বদলি, নিয়োগসহ নানা ইস্যু।
প্যাডেলচালিত রিকশাচালকদের আন্দোলন চলে টানা ৯ দিন। দিনের বিভিন্ন সময় সড়কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট অবরোধ করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুর দিকেই আন্দোলনে নামে আনসারের সদস্যরা। ২৫ আগস্ট সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ করে রাখে সচিবালয়।
রাজপথের আন্দোলনই নয়, এতদিনের বঞ্চিত বলে দাবি-দাওয়া আদায়ে অবস্থান, অনশন হয় সচিবালয়সহ সরকারি অফিসেও। বাদ যায়নি ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারাও। নতুন বছরের শুরুর ২৮ দিনেই আন্দোলন হয়েছে ৪০টি। আন্দোলন হয় ৪৩ বিসিএসে বাদ পড়াদের, ৪০তম এসআই ব্যাচের অব্যাহতিপ্রাপ্তদের, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের দাবিতে, পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসী শব্দকে ঘিরে আন্দোলন সংঘর্ষ হয় ৪ দিন। বিডিআর সদস্যদের পরিবার, ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষকদের আন্দোলনও হয়েছে এই মাসেই। এছাড়াও মঙ্গলবার সারাদেশর ট্রেন যোগাযোগই বন্ধ করে দেয় রানিং স্টাফরা।