আদালত
সাগর-রুনি হত্যার ১৩ বছর আজ
হত্যায় জড়িত কারা সেই রাঘব বোয়াল!
আগামী ২ মার্চ পর্যন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই খুনিদের ধরা হবে বলে সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময় আর শেষ হয়নি!
Printed Edition
নাছির উদ্দিন শোয়েব : সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহরুন রুনি হত্যার ১৩ বছর আজ। ২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ১১৫ বারের মতো পেছানো হয়েছে। আগামী ২ মার্চ পর্যন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই খুনিদের ধরা হবে বলে সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময় আর শেষ হয়নি!
তেরো বছরে সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তে দৃশ্যমান অগ্রগতি না হলেও চার বার বদল হয়েছে তদন্ত সংস্থা। সবশেষ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধানকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয়েছে উচ্চ ক্ষমতার টাস্কফোর্স। এবার হত্যা রহস্য উদ্ঘাটনে আশাবাদী পিবিআইপ্রধান ও বাদীপক্ষের আইনজীবী। আশার বাণী শুনতে শুনতে ক্লান্ত পরিবারের সদস্যরা, চান ন্যায়বিচার। সাগর সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাণ্ডের পর অনেকেই মনে মনে করেছিল এর পেছনে কোনো রাঘব-বোয়াল জড়িত। নানা নাটকীয়তার মধ্যে আলোচিত এ হত্যাকা-ের তদন্ত বার বার থমকে গেছে। থানা থেকে ডিবি, এরপর র্যাব তদন্ত করে জোড়া খুনের এই মামলা। কিন্তু নিহত সাংবাদিক দম্পতির পরিবার দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন তারা এই তদন্তে আশার কিছু দেখেনি। তদন্তের নামে বাদী এবং তার স্বজনদের হয়রানি করারও অভিযোগ ছিল তদন্ত সংস্থা র্যাবের বিরুদ্ধে। একপর্যায় এ হত্যারহস্য উন্মোচনের আশা ছেড়ে দিয়েছিল পরিবার। পাঁচ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তে নতুন মোড় নেয়। এ মামলার তদন্ত র্যাব থেকে স্থানান্তর করা হয়।
তখন এক সভায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, সাগর-রুনি হত্যাকা-ে বিগত সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী লোক জড়িত ছিলেন। প্রাথমিক তদন্তে এমন তথ্য উঠে এসেছে বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, শুধু সরকারের দায়িত্বে ছিলেন তা না, সরকারকে পাশে থেকে যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদের মধ্যেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম এসেছে। আদালত এই বিষয়ে শুনানির জন্য আগামী ৬ এপ্রিল তারিখ ধার্য করেছেন। বিচারপতি ফারাহ মাহাবুব ও বিচারপতি মাহবুবুল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই হত্যা মামলার তদন্ত থেকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) অপসারণের নির্দেশনা চেয়ে সরকারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন। শুনানিতে হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেছে, সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া শুধু নিহতদের পরিবারের জন্যই নয়, গোটা জাতির জন্য মর্মান্তিক। মামলার বাদীর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন এবং অপরাধ তদন্ত বিভাগের প্রতিনিধিরা টাস্কফোর্সের অংশ হতে পারেন। এরপর সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলায় বাদীপক্ষে আইনজীবী হিসেবে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ শিশির মনিরকে নিযুক্ত করা হয়। মামলার বাদী ও রুনির ভাই নওশের আলী রোমান শিশির মনিরকে নিযুক্তির বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানান।
মামলার বাদী নওশের রোমান বলেন, এত বছর তো আমরা আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। বিচার চাওয়াও মনে হচ্ছিল একটা লজ্জাজনক ব্যাপার। এখন নতুন সরকার এসেছে, নির্দলীয় সরকার। আগের সরকার মামলাটা ধামাচাপা দিয়েছিল। ওই সরকার যেহেতু নেই, আমরা মনে করছি কিছু হতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত কিছু না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আনন্দিত বা আশা করার কিছু নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এত দিন যোগাযোগ করত না। তিনি আরও বলেন, তদন্তে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা সফল হবে না। এটি আমরা মেনেও নেব না। যতক্ষণ পর্যন্ত ফলাফল না পাব, ততক্ষণ পর্যন্ত আশাবাদী হতে পারছি না। সারাজীবনই এটার বিচার আশা করব। কোনো ঘটনাকে কীভাবে ধামাচাপা দেয়া হয়, সেটা চোখের সামনে অনেক দেখেছি। যারা তদন্তের সঙ্গে ভালোভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত বলে মনে করি। কারণ আমার ধারণা, তারা অনেক কিছু জানেন ।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনি। সে সময় সাগর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙা টিভি এবং রুনি এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন। এই হত্যার ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। প্রথমে এই মামলা তদন্ত করছিল শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ। চার দিন পর মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ৬২ দিনের মাথায় ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এরপর আদালত র্যাবকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। তখন থেকে মামলাটির তদন্তভার র্যাবের হাতে ছিল। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার ঘটনায় সঠিকভাবে দোষী নির্ণয়ে তদন্তের জন্য প্রয়োজনে ৫০ বছর সময় দিতে হবে বলে দম্ভোক্তি করেছিলেন সাবেক আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী (বর্তমানে কারাগারে) আনিসুল হক। তিনি বলেন, জোর করে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ানো ঠিক হবে না। এদিকে সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক সাজার দাবি জানিয়েছে আসছেন সহকর্মী এবং সাংবাদিক সংগঠনের নোতারা। বাংলাদেশ ফেরাডেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি-আরইউসহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন এ হত্যার সুষ্ঠু বিচার দাবি জানিয়ে আসছে।