DailySangram-Logo-en-H90

গ্রাম-গঞ্জ-শহর

কোথাও কোথাও পানির স্তর খুঁজেই পাওয়া যায়নি

বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভে পানির চরম সংকট ॥ বোরোর এলাকা সংকুচিত

খাদ্য ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভে পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। গত তিন দশকে পানির স্তর ৮ থেকে ১৮ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। বিপজ্জনক ঘটনা হলো, বরেন্দ্রের কোথাও কোথাও পানির স্তরই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

রাজশাহী ব্যুরো
বিশেষ প্রতিনিধি
Printed Edition
Rajshahi-Barind-Pic-22.02
বরেন্দ্র-চিত্র: ভূগর্ভে কিংবা উপরের স্তরে পানির সংকট থাকায় এবার বোরোর আবাদ সংকুচিত করা হয়েছে-ফাইল ফটোNone

বিশেষ প্রতিনিধি, রাজশাহী: খাদ্য ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভে পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। গত তিন দশকে পানির স্তর ৮ থেকে ১৮ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। বিপজ্জনক ঘটনা হলো, বরেন্দ্রের কোথাও কোথাও পানির স্তরই খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে বোরো চাষের এলাকা সংকুচিত করে ফেলতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত বরেন্দ্র অঞ্চলের ৮টি উপজেলায় বোরো চাষে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিএমডিএ।

সূত্র জানায়, গত আশির দশকের আগে পর্যন্ত বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টিনির্ভর আমন ছাড়া অন্য কোনো ফসল হতো না। আমন ওঠার পর মাঠকে মাঠ খালি পড়ে থাকতো। তবে আশির দশকে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-বিএমডিএ যেন এ অঞ্চলের কৃষকদের জন্য আর্শিবাদ হয়ে এসেছিল। তৎকালীন অবিভক্ত রাজশাহী বিভাগের ১৬ জেলায় সেচ কার্যক্রম শুরু করে বিএমডিএ। গভীর নলকূপ বসিয়ে শুরু হয় ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন। ফলে সারাবছরই ফসলের সমারোহে ভরে ওঠে বরেন্দ্রের মাঠ। ফসল উৎপাদনও বাড়ে কয়েকগুণ। তবে সে অবস্থা এখন আর নেই। সেই ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনই যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের ভাগ্যে। কয়েক দশক ধরে উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থের পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। দিনকে দিন পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এমন কী কোনো কোনো উপজেলার কোথাও কোথাও মাটির নিচে পানির স্তরই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর ৮টি উপজেলায় বোরো চাষ সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএমডিএ। এসব উপজেলায় বিএমডিএর গভীর নলকূপের আওতাধীন কৃষি জমিগুলোতে বোরো চাষ এলাকাভেদে অর্ধেক থেকে শূন্যে নামিয়ে আনা হবে। ফলে চলতি মৌসুমে ৮ উপজেলায় ৪০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে বোরো ধান চাষ করতে পারবেন না কৃষকরা। বিএমডিএ কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর, চাপাঁইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার একাংশ, নাচোল, গোমস্তাপুর ও নওগাঁর সাপাহার, পোরশা এবং নিয়ামতপুর উপজেলা সবচেয়ে বেশি পানি সংকটে পড়েছে। এসব উপজেলার বেশির ভাগ গভীর নলকূপেই আর পানি মিলছে না। আর হস্তচালিত প্রায় টিউবওয়েলগুলোই অনেক আগেই অকেজো হয়ে গেছে। ফলে খাবার পানির সংকট মেটাতে হিমশিম অবস্থায় পড়েছেন স্থানীয়রা। রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ২৫টি উপজেলায় ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সরকারি জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। এতে দেখা যায়, এই অঞ্চলে গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গত তিন দশকে ৮ থেকে ১৮ মিটারে নেমে গেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার মতো কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় গড় ভূগর্ভস্থ পানি ২১ মিটার থেকে ৪৬.৮৭ মিটারে নেমে এসেছে।

বিএমডিএ কর্মকর্তারা বলছেন, এক রকম বাধ্য হয়েই তারা আট উপজেলাকে পানিশূন্য হওয়া থেকে রোধ করতেই বোরো চাষ সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সম্প্রতি তারা একটি নতুন নীতিমালা তৈরি করেছেন। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, চলতি বোরো মৌসুমে পানি সংকটাপন্ন এলাকাগুলোতে একটি গভীর নলকূপ বছরে ৯৮০ ঘণ্টার বেশি চালানো যাবে না। পানি সংকটে থাকা আটটি উপজেলায় দুই দশমিক ১৯ লাখ হেক্টর আবাদি জমি রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ৯৫ হাজার হেক্টর জমি বিএমডিএর গভীর নলকূপের আওতাধীন। বাকি এক দশমিক ২৪ লাখ হেক্টর জমি বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন নলকূপের আওতাধীন। পানি সংকটে থাকা আট উপজেলায় সংস্থাটির মোট তিন হাজার ৫৮৮টি সচল গভীর নলকূপ রয়েছে। এরমধ্যে এক হাজার ৯৬০টি নলকূপ তীব্র পানি সংকটপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের প্রাপ্যতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি নলকূপ ২৪ হেক্টর থেকে ৪০ হেক্টর জমিতে পানি সেচ সরবারহ করতে পারে। বিএমডিএর নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্থিতিশীল রাখতে বছরে একটি গভীর নলকূপ মোট ১৯৬০ ঘণ্টা চালানো হবে। এরমধ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ মে পর্যন্ত আসন্ন বোরো মৌসুমে একটি গভীর নলকূপ মোট ৯৮০ ঘণ্টা চলবে। ফলে এসব নলকূপের আওতাধীন জমিতে বোরো ধান চাষ অর্ধেক থেকে শূন্যে নামিয়ে আনা হবে।

বিএমডিএ’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, “আট উপজেলায় আমাদের এক হাজার ৯৬০টি নলকূপ তীব্র পানি সংকটপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি নলকূপের আওতাধীন জমিতে আমরা কৃষকদের অনুরোধ করেছি, বোরো ধান চাষ না করার জন্য। বাকি ৮৩০টি গভীর নলকূপের অর্ধেক জমিতে বোরো ধান এবং বাকি অর্ধেক জমিতে ভুট্টা ও গমের মতো অন্যান্য ফসল চাষ করার জন্যও কৃষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছি। কারণ অন্যান্য ফসলের তুলনায় বোরো ধান চাষে পাঁচ থেকে ছয়গুণ বেশি পানির প্রয়োজন হয়। এ বিষয়ে বিএমডিএর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “যেসব এলাকায় পানি সংকট, সেসব এলাকায় আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গভীর টিউবওয়েল চালালে তো আমাদেরই লাভ হবে। কিন্তু এটি করলে সবার ক্ষতি। তাই আমরা যেসব অঞ্চলে পানি কম, সেসব অঞ্চলে ধানের পরিবর্তে গম বা অন্য ফসল চাষ করতে বলেছি।”