রাজধানী
ছাত্র জনতার বিপ্লব : গৌরব গাঁথা
পুলিশের গুলীতে অকালে ঝরে যায় শহীদ হাফেজ সাব্বিরের প্রাণ
শহীদ হাফেজ সাব্বিরের জীবন হয়ত কোনো বড় নিউজে আসেনি। কিন্তু তার সেই শেষ মুহূর্তে দেয়া এক বোতল পানি অনেক আন্দোলনকারীর জন্য হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার উপহার।
Printed Edition

শহীদ হাফেজ সাব্বিরের জীবন হয়ত কোনো বড় নিউজে আসেনি। কিন্তু তার সেই শেষ মুহূর্তে দেয়া এক বোতল পানি অনেক আন্দোলনকারীর জন্য হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার উপহার। আমাদের ইতিহাসে এমন সব না-জানা সাব্বিরদের নাম হয়ত পেছনে পড়ে যায়। কিন্তু তাদের প্রতিটি কাজ বিপ্লবের ইতিহাসে অনুপ্রেরণা হয়ে রয়ে যায়। হাফেজ সাজ্জাদ হোসেন সাব্বিরের আত্মত্যাগ আমাদেরকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একত্রে থাকার শক্তি যোগাবে। বিপ্লবের প্রতিটি ধাপে হাফেজ সাব্বিরের মুগ্ধতা মনে রাখবে এ প্রজন্ম। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলীতে অকালেই ঝরে যায় কুরআনের পাখি শহীদ হাফেজ মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসাইন সাব্বির। জন্ম ২০০৫ সালের ২ অক্টোবর চাঁদপুর জেলার রঘুনাথপুর গ্রামে। জামিয়া কুরআনিয়া ইমদাদুল উলুম ফুরকানিয়া মাদরাসায় পড়ালেখা করেছেন। জীবনের স্বপ্ন ছিল হাফেজ হয়ে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেবেন। কিন্তু পুলিশের বুলেটে থেমে গেল সাব্বিরের স্বপ্ন। তিনি চাঁদপুর শহরের রঘুনাথপুর গ্রামের রাজা বাড়ীর মো. জসিম উদ্দিন রাজার ছেলে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয় লাভের মাত্র অল্প ক’দিন আগেই ঢাকা মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় মসজিদে আসর নামায আদায় করে মিছিলে গিয়ে পুলিশের গুলীতে প্রাণ হারান শহীদ হাফেজ মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসাইন সাব্বির। শুক্রবার ১৯ জুলাই ২০২৪ বিকেলে মাত্র ১৮ বছর বয়সে এই কুরআনে হাফেজ শহীদ মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসাইন সাব্বির অকালে ঝরে যাওয়ায় এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। নাড়িছেঁড়া ধন শহীদ হাফেজ মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসাইন সাব্বিরের শেষ স্মৃতিটুকু তার দুখিনী মায়ের কাছে নেই। ধর্মীয় আবেগের কারণে তার রক্তমাখা পাঞ্জাবি, পায়জামা ও টুপি তার কবরের পাশেই মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জের ঐতিহাসিক ফুল ছোঁয়া কওমি মাদরাসায় কুরআনের তালিম নেন হাফেজ মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসাইন সাব্বির। হাফেজ হওয়ার পর একই মাদরাসায় তিনি মিজান বিভাগে ২ বছর পড়াশোনা করেন। কিন্তু আর্থিক অনটনসহ নানান কারণে আর পড়াশোনা এগিয়ে নিতে পারেননি। দিনমজুর পিতার সাথে সংসারের হাল ধরতে কাজ শিখার উদ্দেশ্যে ঢাকায় পাড়ি জমান। মিরপুর-১ এর চিড়িয়াখানা রোডে ঢাকা মটরস নামে একটি অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে কাজে যোগ দেন। থাকতেন মিরপুর ২ নম্বরে শ্রমজীবী মামা নাসিরের বাসায়।
যেভাবে শহীদ হন : ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই। গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল সময়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিবাদী সরকারের দমন পীড়ন তাকে ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। ১৯ জুলাই ২০২৪ শুক্রবার দুপুরে সাব্বির ছুটে আসেন মিরপুর-১০ নম্বরে বিক্ষোভে অংশ নিতে। আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়িয়ে পানি দিতে গিয়ে গুলীবিদ্ধ হন সাব্বির। ঘটনাস্থল মিরপুর। একটি বোতল পানির মুগ্ধতায় জীবনের গল্প শেষ হয়ে গেল সাব্বিরের। বিকেলে হঠাৎ পুলিশের গুলী তার গায়ে বিদ্ধ হয়। তাৎক্ষণিক মাটিতে লুকিয়ে পড়েন হাফেজ মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসাইন সাব্বির। ঘাতকের বুলেট তার পেটের ডান দিক দিয়ে ঢুকে বাম পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। আন্দোলনকারীদের একজন তাকে উদ্ধার করে দ্রুত নিয়ে যান মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশনে। কর্মরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাফেজ মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসাইন সাব্বিরের সাথে থাকা মোবাইল নাম্বার থেকে তার মামা নাসিরকে পুলিশের গুলীতে মৃত্যুর খবর জানানো হয়। খবর পেয়ে দ্রুত ছুটে আসেন মামা নাসির। হতভাগা ভাগিনার লাশ উদ্ধার করে ঐদিন রাতেই চাঁদপুরে নিয়ে আসেন তিনি। পরদিন শনিবার ২০ জুলাই ২০২৪ সকালে চাঁদপুর পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডস্থ রঘুনাথপুর গ্রামে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। নামাযে জানাযায় ইমামতি করেন রঘুনাথপুর বাজার মসজিদের ইমাম মুফতি তানিম আহমেদ। এ সময় তার রক্তমাখা জামা কাপড় কবরের পাশেই মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়।
পরিবারের সদস্য ও শিক্ষার্থীদের অভিব্যক্তি : রঘুনাথপুর গ্রামের রাজা বাড়ির বাসিন্দা দিনমজুর মোঃ জসিম উদ্দিন রাজার দুই ছেলের মধ্যে সাব্বির বড়। ছোট ছেলে শাফায়াত স্থানীয় রঘুনাথপুর মাদরাসায় পড়াশোনা করছে। সন্তানের লাশ কাঁধে নেয়া হতভাগা পিতা জসিমের স্বপ্ন ছিল তার ছেলে অনেক বড় ইসলামিক চিন্তাবিদ হবে। দেশে-বিদেশে কুরআনের বাণী ছড়িয়ে দিবে। কিন্তু ঘাতকের বুলেট তার স্বপ্নকে চুরমার করে দিল। হতভাগা পিতার দাবি তার ছেলেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা প্রদান করা হোক। তার ছেলের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এসেছে, তাতে যেন দেশের মানুষ সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারে এমন কামনা তার।
শহীদ সাব্বিরের পিতা মো. জসিম রাজা বলেন, আমার সন্তান দেশের জন্য, মানুষের অধিকারের জন্য শহীদ হয়েছে। এটি একদিকে যেমন বেদনার, অপরদিকে গর্বের। আমার সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমি চাইনা আর কোন মায়ের বুক এভাবে খালি হোক। আমার সন্তানদের জীবনের বিনিময়ে হলেও বাংলাদেশ সকল অন্যায়, অবিচার, গুম, খুন, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত হোক। যে শিক্ষার্থীরা মানুষের অধিকার আদায়ের রাজপথে নেমে এসেছে তারা আমাদের দেশের সম্পদ। কেউ যেন আর তাদের বুকে গুলী না চালায়।
নাড়িছেঁড়া ধন ছেলেকে হারিয়ে দুখিনী মা শাহনাজ বেগম পাগলপ্রায়। দীর্ঘদিন পরেও তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন। পরিবারের লোকজনের সাথে অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। রাত বিরাতে সাব্বির আসছে বলে চিৎকার দিয়ে ঘরের বাইরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ছেলের পুরনো জামা কাপড় জড়িয়ে বিলাপ করছেন। স্থানীয় চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করেও তেমন অগ্রগতি হচ্ছে না। তাই প্রায় সময় ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে তাকে অচেতন করে রাখার চেষ্টা করছেন। ছেলেকে হারিয়ে শোকে কাতর মা শাহনাজ বেগম বলেন ‘পুলিশ যেন পরিবারের একজনকে না, বরং সকলকে গুলী করে হত্যা করেছে। কারণ, ছেলেকে হারিয়ে আমাদের পরিবার এখন জিন্দালাশ। চাচা মোঃ তানভীর রাজা জানান, আমার বড় ভাইয়ের ছেলে সাব্বিরকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। সে অনেক বড় মাওলানা হবে, মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিবে। তিনি মহান আল্লাহ কাছে ঘাতকদের শাস্তির দাবি করেন। শহীদ হাফেজ মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসাইন সাব্বিরের বৃদ্ধ দাদা দুদু রাজা বর্তমান সরকারের কাছে তার নাতির হত্যাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানান।
চাঁদপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা বলেন, শুক্রবার ১৯ জুলাই ২০২৪ মিরপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে চিড়িয়াখানা রোডে আমাদের ভাই হাফেজ সাজ্জাদ হোসাইন সাব্বির (১৮) শহীদ হয়েছে। সে কেবল আপনার সন্তানই নয়, সে আমাদের সকল ছাত্রদের পরিবারের একজন সদস্য। আজকে (মঙ্গলবার ২০ আগস্ট ২০২৪) আমরা যারা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি, তারা সবাই আপনার সন্তান। এমন শত শত শহীদ সাব্বিরদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ বৈষম্য শিক্ষার থেকে মুক্ত হতে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, আমরা আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনার সন্তান হিসেবে আমরা চাঁদপুরের সকল শিক্ষার্থী আপনার পাশে থাকব। আপনি যে কোন প্রয়োজনে এই সন্তানদেরকে ডাকবেন, আমরা ছুটে আসব। আমরা শহীদ সাব্বিরের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহ যেন তাকে জান্নাত দান করেন।
সাব্বিরের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু (সম্পর্কে ফুফাত ভাই) জিল্লুর রহমান সিফাত। তিনি চাঁদপুর কারিগরি বিদ্যালয় ও কলেজের দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। সিফাত বলেন, ছোটবেলা থেকেই সাব্বির আমার সাথে চলাফেরা করত। পুরো শৈশবে আমাদের অনেক স্মৃতি আছে। ২০২৪ সালের ঈদুল ফিতরের পর বন্ধুদের নিয়ে আমরা বান্দরবান ভ্রমনে গিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের সঙ্গে সাব্বিরও ছিল। পরবর্তী ভ্রমণে আমরা কক্সবাজার যাব এমন পরিকল্পনা ছিল। সাব্বির শহীদ হওয়ার পর আমাদের সে পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। সিফাত আরও বলেন, ১৭ জুলাই ২০২৪ আমার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় সাব্বিরের। আমাদের বন্ধুদের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছিল। ওই গ্রুপেই কথা হয় তার সঙ্গে। আমি সাব্বিরের কাছে জানতে চাই কি অবস্থা ঢাকার। সে পরিস্থিতি জানায়। তাকে কয়েক বার নিষেধ করেছি তুমি আন্দোলনে যাবে না। কিন্তু সে আমাদের কথা শোনেনি। ঘটনার দিন বিকেলে আন্দোলনে গিয়ে গুলীবিদ্ধ হয়।
শহীদ সাজ্জাদের বাবা জসিম রাজা জানান, চাঁদপুর জেলা পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নির্বাহী মেজিস্ট্রেট প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে দেখা করেন। আর রাজনৈতিক দলের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর নেতারাসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা তাদের সঙ্গে দেখা করে সহমর্মিতা জানিয়েছেন। এর মধ্যে প্রশাসনের কর্মকর্তারা যাওয়ার সময় বিভিন্ন আইটেমের ফল নিয়ে যান এবং ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতা করেন।
শহীদ সাব্বিরের বাড়িতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকায় পুলিশের গুলীতে নিহত চাঁদপুর শহরের রঘুনাথপুর এলাকার শহীদ হাফেজ সাজ্জাদ হোসেন সাব্বিরের বাড়িতে ছুটে যান চাঁদপুরের ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার (২০ আগস্ট ২০২৪) বিকেলে শিক্ষার্থীরা শহীদ সাব্বিরের পিতা মো. জসিম রাজা এবং তার মা ছেলের স্মৃতিকথা তুলে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় সেখানে আবেগঘন পরিবেশে সৃষ্টি হয়। পুলিশের গুলীতে নিহত সাব্বিরের মায়ের বুকফাটা আর্তচিৎকার কান্নায় ভেঙে পড়েন আগত শিক্ষার্থীরাও। পরে শহীদ সাব্বিরের কবর জিয়ারত শেষে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে তার পরিবারের হাতে নগদ অর্থ এবং বিভিন্ন খাদ্য উপহার তুলে দেয়া হয়।