রাজধানী
ঢাবিতে দুই দিনব্যাপী ইন্টারন্যাশনাল মাল্টিফেইথ কর্মশালা
সব ধর্মের মানুষকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন ও ধর্মীয় সম্প্রীতি গড়ে তোলার আহ্বান
যেখানে যুদ্ধ নয় শান্তি থাকবে এবং থাকবে সব ধর্মের মানুষের প্রতি সম্মান ও সুসম্পর্ক এবং ন্যায্য অধিকার। অন্যান্য ধর্মের মানুষের সাথে সম্প্রীতি বজায় রাখার বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা আছে।
Printed Edition
সব ধর্মের মানুষকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে দু’দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক মাল্টিফেইথ কর্মশালার প্রথম দিনে দেশি ও আন্তর্জাতিক ধর্মীয় নেতা-গুরু ও ইসলামীক স্কলারগণ বলেন, আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। এ সময় ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আমরা একসাথে আন্তঃধর্ম সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবো। যেখানে যুদ্ধ নয় শান্তি থাকবে এবং থাকবে সব ধর্মের মানুষের প্রতি সম্মান ও সুসম্পর্ক এবং ন্যায্য অধিকার। অন্যান্য ধর্মের মানুষের সাথে সম্প্রীতি বজায় রাখার বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা আছে। মানুষের মধ্যে ধর্ম ও বর্ণের বৈচিত্র্য থাকলেও, সৃষ্টির দিক থেকে আমরা সবাই সমান। আল্লাহ আমাদের প্রথম পিতা আদম (আ.) ও মাতা হাওয়া (আ.) থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষকে সম্মানের সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন। ইসলামই একমাত্র পথ নির্দেশক ধর্ম যা ধর্মের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই বলে শিক্ষা দেয় প্রত্যেক মুসলমানকে।
গতকাল সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে আয়োজিত এক কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ কেন্দ্র, যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মাল্টি-ফেইথ নেইবারস নেটওয়ার্ক (এমএফএনএন) এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট (বিআইআইটি) যৌথভাবে এই কর্মশালা আয়োজন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান প্রধান অতিথি হিসেবে এই কর্মশালার উদ্বোধন করেন। কর্মশালা আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক এবং আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াছের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, মাল্টি-ফেইথ নেইবারস নেটওয়ার্কে সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড. বব রবার্টস জুনিয়র, ইসলামিক সোসাইটি অব নর্থ আমেরিকার (আইএসএনএ) চেয়ারম্যান ইমাম মোহাম্মদ মাজিদ, বাংলাদেশ ক্যাথলিক চার্চের প্রধান আর্চবিশপ বিজয় এন ডিক্রুজ, ঢাকায় রামকৃষ্ণ মিশনের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য স্বামী অম্বেশানন্দ, বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এম শমশের আলী, আইআরএফ সেক্রেটারিয়েট এর প্রেসিডেন্ট নাদিন মায়েনজা, ইনস্টিটিউট অব গ্লোবাল এনগেজমেন্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জেমস চেন, গ্লোবাল মুসলিম অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র অ্যাডভাইজার সাইয়েদ মুক্তাদির, অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের সুপার নিউমারারি অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া। উপস্থিত ছিলেন- বিআইআইটি এর মহাপরিচালক ও আইডব্লিওএমডি ২০২৫ এর যুগ্ম-আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এম আব্দুল আজিজ, ঢাবির বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আবু সায়েম, হিন্দু মহাজোটের এডভোকেট গোবিন্দ প্রমাণিক প্রমুখ। উল্লেখ্য, কর্মশালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন ধর্মতত্ত্ব এবং হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মীয় শতাধিক নেতৃবৃন্দ ও সংস্থার প্রতিনিধিরাসহ গণমাধ্যমের সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
ভিসি অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। এ সময় ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে দেশের ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই অভ্যুত্থান থেকে শিক্ষা নিয়ে সমাজের সকল বৈষম্য দূর করতে হবে। সামাজিক বিভক্তি দূর করে পারস্পরিক ঐক্য, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি আরও সুদৃঢ় করতে হবে। এই কর্মশালা এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। সম্মেলনটি বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি অনন্য ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
মাল্টি-ফেইথ নেইবারস নেটওয়ার্কে সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড. বব রবার্টস জুনিয়র বলেন, আমরা একসাথে আন্তঃধর্ম সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবো। যেখানে যুদ্ধ নয় শান্তি থাকবে এবং থাকবে সব ধর্মের মানুষের প্রতি সম্মান ও সুসম্পর্ক এবং ন্যায্য অধিকার।
ইসলামিক সোসাইটি অব নর্থ আমেরিকার (আইএসএনএ) চেয়ারম্যান ইমাম মোহাম্মদ মাজিদ বলেন, অন্যান্য ধর্মের মানুষের সাথে সম্প্রীতি বজায় রাখার বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা আছে। মানুষের মধ্যে ধর্ম ও বর্ণের বৈচিত্র্য থাকলেও, সৃষ্টির দিক থেকে আমরা সবাই সমান। আল্লাহ আমাদের প্রথম পিতা আদম (আ.) ও মাতা হাওয়া (আ.) থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষকে সম্মানের সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন। ইসলামই একমাত্র পথ নির্দেশক ধর্ম যা ধর্মের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই বলে শিক্ষা দেয় প্রত্যেক মুসলমানকে।
বাংলাদেশ ক্যাথলিক চার্চের প্রধান আর্চবিশপ বিজয় এন ডিক্রুজ বলেন, বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ। সব ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে সৌহার্দ্যের সঙ্গে এদেশে বসবাস করে। এদেশের মানুষ ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে অধিকারে বৈষম্য বা বিভাজন করে না। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশটিতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের মানুষের নিরাপত্তা রয়েছে। সকল নাগরিকের সম্পৃক্ততার মাধ্যমেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ঐক্য ও শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে। ঢাকায় রামকৃষ্ণ মিশনের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য স্বামী অম্বেশানন্দ বলেন, সত্যিকারের কোনো ধার্মিক মানুষ অন্য ধর্মের ঐতিহ্যের অনন্য ধর্মতাত্ত্বিক পরিচয়কে অসম্মান করে না। শান্তিময় সমাজ নিশ্চিত করতে প্রতিটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকেই সহানুভূতিশীল ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধসম্পন্ন হতে হবে। বিভিন্ন ঐতিহ্যের ধর্মীয় নেতাদের সমন্বিত সহযোগিতার মাধ্যমেই একটি স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব।
বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এম শমশের আলী বাংলাদেশকে নানা ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলনকেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, আবহমানকাল থেকেই এ দেশে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি বিরাজ করছে। বাংলাদেশ হলো সবচেয়ে কম সাম্প্রদায়িক সংঘাতের দেশ।
আইআরএফ সেক্রেটারিয়েট এর প্রেসিডেন্ট নাদিন মায়েনজা বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক মূলক ইন্টার-ফেইথ হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে ভিন্নমত, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন শ্রেণি, গোষ্ঠী বা জাতির মানুষকে সমানভাবে মূল্যায়ন করা হয়। এই রাজনীতি বৈচিত্র্যকে শক্তি হিসেবে বিবেচনা এবং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে।
ইনস্টিটিউট অব গ্লোবাল এনগেজমেন্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জেমস চেন বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্টার-ফেইথ এর দৃষ্টিভঙ্গি হলো, সব মানুষের জন্য সমান সুযোগ, অধিকার ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা। এটি ভিন্ন মতাদর্শ, ধর্ম বা গোষ্ঠীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সমঝোতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে গুরুত্ব দেয়। জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বিভাজনের পরিবর্তে ঐক্য গড়ে তুলতে সাহায্য করে, যা শান্তি, স্থিতিশীলতা, টেকসই উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।
গ্লোবাল মুসলিম অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র অ্যাডভাইজার সাইয়েদ মুক্তাদির বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্টার-ফেইথ সংস্কৃতিতে বিভিন্ন জাতিগত, ধর্মীয় বা অন্যান্য পার্থক্যকে শুধু সহ্য নয়, বরং উৎসাহিত এবং মূল্যায়ন করা হয়। এভাবে বৈচিত্র্যকে শক্তি ও সম্পদ হিসেবে দেখা হয়। সামাজিক সংহতি ও একতা তৈরিতে সাহায্য করে। প্রতিটি মানুষ, তার মত, বিশ্বাস এবং অবস্থানসহ, শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে গ্রহণ করবে।
অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্টার-ফেইথ বা মাল্টি ফেইথ সংস্কৃতি তৈরি করতে হলে, সেটা শুধু সামাজিক নয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও সক্রিয় প্রচেষ্টা হতে হবে। এর মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল সমাজ গঠন সম্ভব, যেখানে সবাই নিরাপদ, সম্মানিত এবং সক্রিয়ভাবে জীবনযাপন করতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের সুপার নিউমারারি অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া বলেন, দেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও সম্প্রদায়নির্বিশেষে মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা-ই সম্প্রীতি; আবহমান কাল থেকেই এতদঞ্চলের মানুষের মাঝে ধর্মীয় সম্প্রীতির সদ্ভাব বজায় রয়েছে। এদেশে সবধর্মের মানুষ ভাই ভাই হিসেবে শত শত বছর ধরে বসবাস করছে। বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান-এ চারটিই প্রধান ধর্ম। উল্লেখ্য যে, এ চার ধর্মের কোনোটিই বাংলাদেশের আদি ধর্ম নয়। হিন্দু ধর্মের সঙ্গে এ দেশের মানুষের পরিচয় ঘটেছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। এরপর বৌদ্ধ ধর্ম এসেছে আড়াই হাজার বছর আগে, ইসলাম ধর্ম এসেছে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এবং খ্রিষ্টধর্ম এসেছে প্রায় ৬০০ বছর আগে।
বিআইআইটি এর মহাপরিচালক ও আইডব্লিওএমডি ২০২৫ এর যুগ্ম-আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এম আব্দুল আজিজ বলেন, বাংলাদেশের সব ধর্মাবলম্বী মানুষ ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় পালন করে থাকে তাদের স্ব-স্ব ধর্মীয় উৎসব; একের উৎসবে যোগ দেয় ভিন্ন ধর্মের অনুসারীরাও আর এভাবেই বাংলাদেশের ধর্মীয় উৎসবগুলোও সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়। এ দেশে যেমন মুসলিমদের জন্য মসজিদভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে, ঠিক তেমনি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্যও সরকারি অর্থায়নে মন্দিরভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠাগার চালু রয়েছে; বৌদ্ধ ধর্মগুরু জ্ঞানতাপস অতীশ দীপঙ্করের নামে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। গঠন করা হয়েছে খ্রিষ্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট এইসব কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির প্রত্যাশিত রূপটিই ফুটে ওঠে।
উল্লেখ্য যে, আজ ১১ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, সন্ধ্যা ৬.৩০ থেকে রাত ৮.৩০ পর্যন্ত সম্মেলনে সমাপনী অনুষ্ঠান হবে। এতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. এ এফ এম খালিদ হোসেন প্রধান অতিথি এবং ঢাবি’র প্রোভিসি (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।