DailySangram-Logo-en-H90

রাজধানী

পিলখানায় সেনা হত্যা

১৬টি বছর আমাদের মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছিল: নেহরীন ফেরদৌসী

১৬টি বছর আমাদের মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। আমরা অনেক কিছুই প্রকাশ করতে পারিনি। একেকজন চৌকস সেনা অফিসারকে নির্মমভাবে ওরা যেভাবে হত্যা করেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আমরা এখন স্বাধীন বাংলাদেশে এই হত্যাকান্ডের বিচার চাই।

স্টাফ রিপোর্টার
Printed Edition
image01

১৬টি বছর আমাদের মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। আমরা অনেক কিছুই প্রকাশ করতে পারিনি। একেকজন চৌকস সেনা অফিসারকে নির্মমভাবে ওরা যেভাবে হত্যা করেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আমরা এখন স্বাধীন বাংলাদেশে এই হত্যাকান্ডের বিচার চাই। শুধু খুনিদের নয়, যারা নেপথ্যে ছিল, ইন্ধন দিয়েছে তাদের সবার। আর কোনো দিন যেনো কেউ এরকম পাশবিকতা না চালাতে পারে সেজন্য দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করার দাবি জানাই।

এই কথাগুলো ২০০৯ সালে পিলখানায় বিপথগামী বিডিআর সদস্যদের হাতে নিহত শহীদ কর্নেল মো. মুজিবুল হকের স্ত্রী নেহরীন ফেরদৌসীর। নেহরীন ফেরদৌসী রোববার দুপুরে দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, শহীদ সেনা পরিবার ব্যথিত, আতঙ্কিত। কর্নেল মো. মুজিবুল হক সে সময় বিডিআরের ঢাকা সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। হত্যার পর তার লাশ ড্রেনে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। দু‘দিন খোঁজাখুঁজির পর কামরাঙ্গিরচর এলাকায় ড্রেন থেকে বিকৃত অবস্থায় মুজিবুল হকের লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি জানান, সম্ভবত ড্রেনে তার লাশই প্রথম পাওয়া যায়। এরপর অন্যান্য শহীদ সেনা কর্মকর্তার লাশও ড্রেন থেকে তোলা হয়।

বিডিআর বিদ্রোহের সেদিনের কথা স্মরণ করে নেহরীন মুজিব বলেন, সেদিন কর্নেল মুজিব কিছুই আঁচ করতে পারেননি। বাসা থেকে চা খেয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন দরবার হলের উদ্দেশে। দরবার হলে সেদিন তিনি পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। মুজিবসহ মেধাবী এ অফিসারদের সাহস আর ত্যাগের জন্য আমি গর্ববোধ করছি, কিন্তু দুঃখ একটাই, তাদের সাহসিকতাকে জাতির কাছে প্রমাণ করতে গিয়ে এমনভাবে জীবন দিতে হলো। এ দেশ তাদের শূন্যতা অনুভব করবে দীর্ঘদিন। আর স্বজন হারানোর বেদনা আমাদের সঙ্গী হয়ে থাকবে চিরকাল। নেহরীন ফেরদৌসী বলেন, সেই স্মৃতিগুলো মনে করার মতো নয়। আমি জিমে ছিলাম। মেয়েটি ছিল স্কুলে। ছোট ছেলেটি গৃহকর্মীর সাথে ছিল বাসায়। তিনি যখন বিকেলে পিলখানার ভেতরে গোলাগুলীর খবর জানতে পারেন, তখন কল্পনাও করতে পারেননি সেখানে এতবড় ঘটনা ঘটছে। তিনি তখন বাসায় আসতে চাইলে অন্যরা তাকে বাইরের অবস্থা ভালো না বলে জানান। তারা নেহরীনকে জানান, পিলখানায় অনেক বড় ঘটনা ঘটছে, সেখানে দিনভর গোলাগুলী হচ্ছে। এমনকি বিডিআর জওয়ানরা অফিসারদেরকে জিম্মি করে ফেলছে। তারা অফিসারদের কোয়ার্টারে হানা দিচ্ছে। স্বামী ও সন্তানের চিন্তায় বিভোর হয়ে তিনি আল্লাহকে ডাকতে থাকেন। দু’দন পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে তিনি দ্রুত ছুটে আসেন। ছেলেটি পালিয়ে থাকায় অক্ষত অবস্থায় ছিল। ঘটনার সময় বাসায় ঢুকে দুর্বত্তের মতো লুটতারাজ চালিয়েছে বিপথগামী বিডিআর জওয়ানরা। এ অবস্থায় তিনি ছেলে ও মেয়েকে নিরাপদে এক আত্মীয়ের বাসায় রেখে বেরিয়ে পড়েন পিলখানা সদর দফতরে স্বামীর খোঁজে। কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। একপর্যায় কামরাঙ্গিরচর এলাকায় উদ্ধার কর্মীরা মুজিবুল হকের লাশের সন্ধান পান। চেহারা বিকৃত অবস্থায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ড্রেন থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়। খুনিরা নির্মমভাবে হত্যার পর চেহারা বিকৃত করে ড্রেনে ফেলে দেয় লাশ। ড্রেনে ভেসে সেই লাশ কামরাঙ্গীরচরে চলে যায়। লাশটি ছিল ক্ষতবিক্ষত, মাথার খুলি ভাঙা। একাধিক ক্ষত ছিল শরীরে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে এবং গুলী করে তিনতলা থেকে তাকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

নেহরীন ফেরদৌসী বলেন-‘আমি যদি দেখি, যারা পিলখানায় আমার স্বামীসহ সেনা কর্মকর্তাদের পৈশাচিকভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, গুলী করে হত্যা করেছে, তাদের লাশ ড্রেনে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, পুড়িয়ে ফেলেছে, গর্ত খুঁড়ে মাটিচাপা দিয়েছে, আমাদের বাসায় লুটপাট চালিয়েছে, আমাদের পরিবারের নারী ও শিশুদের কোয়ার্টার গার্ডে আটকে রেখে চরম নির্যাতন চালিয়েছে, সেই অপরাধীরা কারামুক্ত হয়ে আমাদের চোখের সামনে বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে-তাহলে ভাবব এই দেশ আমার না, আমাদের সন্তানদের না, আমাদের সেনা পরিবারগুলোর না।’

তিনি বলেন, ‘পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের হত্যাকা-ের ঘটনা সংশ্লিষ্ট বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় সম্প্রতি অনেক বিডিআর জওয়ান জামিনে মুক্ত হয়েছেন। যদিও তারা এখনো অভিযোগমুক্ত নন। কিন্তু তাদের কারামুক্তি নিয়ে যে ধরনের আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ হয়েছে তাতে আমরা ব্যথিত এবং আতঙ্কিত। হত্যা মামলায় যারা সাজাপ্রাপ্ত, যারা এখনো কারাবন্দী তাদের মুক্তির দাবি নিয়ে আন্দোলনের ঘটনাও ঘটছে। এ অবস্থায় আমরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। নানাভাবে হুমকিও আসছে বলে জানান তিনি।

নেহরীন ফেরদৌসী জানান, কর্নেল মো. মুজিবুল হক সে সময় বিডিআরের ঢাকা সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার অবসরে যাওয়ার দুই মাস বাকি ছিল। তিনি বলেন, নিয়ম হচ্ছে অবসরে যাওয়ার এক বছর থেকে ৬ মাস আগে নিজ নিজ বাহিনীতে ফেরত পাঠাতে হয়। সে অনুযায়ী কর্নেল মুজিবুল হককে আরও আগেই সেনাবাহিনীতে ফেরত পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু অবসরে যাওয়ার আগেও নিয়ম ভেঙ্গে তাকে বিডিআরে রাখা হয়। তাকে সেনাবাহিনীতে ফেরত না পাঠিয়ে বিডিআরে রেখে দেওয়া ষড়যন্ত্র ছিল বলে মন্তব্য করেন নেহরীন ফেরদৌসী। তিনি বলেন, চৌকস অফিসারদেরকে এভাবে বিডিআরে জমায়েত করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে আমাদের মনে হয়। এভাবে সেনাবাহিনীর অনেক চৌকস অফিসারকে সেদিন পিলখানা দরবার হলে একসাথে হত্যা করা হয়। তার দাবি এটি নিশ্চয়ই পরিকল্পিত, রাষ্ট্রীয় মদত ছাড়া এটা হতে পারে না। নেহরীন ফেরদৌসী বলেন, এই হত্যাকান্ডের পেছনে যেই থাকুক সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, এর সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বা দেশটির কোনো বাহিনীর সদস্য জড়িত থাকলে তাদেরকেও শাস্তির আওতায় আনা উচিত। তবে বিপথগামী বিডিআর জওয়ানরা সবাই নিরপরাধ, শুধুমাত্র একটি দেশের কতিপয় লোকই জড়িত আছে এ কথা বিশ^াসযোগ্য নয়। যারা সরাসরি জড়িত ছিলেন, যারা নেপথ্যে ছিলেন, যেসব নেতারা ইন্ধন দিয়েছেন, যারা সেনা অফিসারদেরকে রক্ষায় এগিয়ে আসেননি সবার বিচার হতে হবে।