DailySangram-Logo-en-H90

রাজধানী

ছাত্র-জনতার বিপ্লব : গৌরব গাঁথা

গুলীবিদ্ধ যুদ্ধাহত বড় ভাইকে ‘গাজী’ বলে বের হয়ে ফিরে আসে লাশ হয়ে শহীদ হাফেজ ইমরান

‘ভাই, তুমি তো বেঁচে থেকে গাজী হয়েছো। দেখবা, আমি শহীদ হবো।’ জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বিপ্লবে গুলীবিদ্ধ যুদ্ধাহত বড় ভাই তোফায়েলকে এভাবেই বলেছিল হাফেজ মোনায়েল আহমেদ ইমরান। পরিবার তিন দিন তাকে ঘরে আটকে রাখে, তবে কোমল পানীয় আনার কথা বলে মাকে ফাঁকি দিয়ে বের হয়ে যায় ইমরান। কিন্তু ফিরে আসে লাশ হয়ে।

মুহাম্মদ নূরে আলম
Printed Edition
Sajjad-1

‘ভাই, তুমি তো বেঁচে থেকে গাজী হয়েছো। দেখবা, আমি শহীদ হবো।’ জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বিপ্লবে গুলীবিদ্ধ যুদ্ধাহত বড় ভাই তোফায়েলকে এভাবেই বলেছিল হাফেজ মোনায়েল আহমেদ ইমরান। পরিবার তিন দিন তাকে ঘরে আটকে রাখে, তবে কোমল পানীয় আনার কথা বলে মাকে ফাঁকি দিয়ে বের হয়ে যায় ইমরান। কিন্তু ফিরে আসে লাশ হয়ে।

জুলাই-আগস্ট বিপ্লব ২০২৪ চলাকালে শহীদ হয়েছে হাফেজ মোনায়েল আহমেদ ইমরান। গুলীবিদ্ধ হয়েছেন তার আপন বড় ভাই তোফায়েল আহমেদও। এখনো তোফায়েলের শরীরে ১৮টি গুলী রয়েছে। এক ছেলের শহীদ হওয়ার পর অন্য ছেলের ভবিষ্যৎ ও চিকিৎসা নিয়ে পুরো পরিবার চিন্তিত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার রামপুরা গ্রামের বাসিন্দা তোফায়েল ও ইমরান। তোফায়েল ঢাকায় ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করছিলেন। ইমরান হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলায় নানার বাড়িতে থেকে একটি মাদরাসায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছিল।

এক স্বজনের বিয়ের দাওয়াতে সে বাবা-মায়ের কাছে নারায়ণগঞ্জে আসে। এখানেই সে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়। তোফায়েল বুধবার ১৭ জুলাই ২০২৪ নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার সাইনবোর্ড এলাকায় গুলীবিদ্ধ হন। রোববার ২১ জুলাই ২০২৪ একই এলাকায় গুলীবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ইমরান। নাসিরনগরের গ্রামের বাড়িতে হাফেজ ইমরানের দাফন সম্পন্ন হয়। তোফায়েল তার বাবা-মায়ের সঙ্গে সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় এলাকায় থাকেন। তোফায়েল ও ইমরানের বাবা সোয়াব মিয়া ঢাকায় পুরান কাপড়ের ব্যবসা করেন। মা ইয়াসমিন আক্তার গৃহিণী। তাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। এক ছেলে ও এক মেয়ে নারায়ণগঞ্জে মায়ের সঙ্গে এবং বাকি দুজন নানার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত।

যেভাবে শহীদ হয় হাফেজ ইমরান : বৃহস্পতিবার ১৮ জুলাই ২০২৪ তোফায়েলের গুলীবিদ্ধ হওয়ার দৃশ্য দেখে ঢাকায় বেড়াতে আসা তার ছোট ভাই এবং লাখাইয়ের জিরুন্ডা মানপুর তোফায়েলিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার ৮ম শ্রেণির ছাত্র হাফেজ ইমরান সহ্য করতে পারেননি। ফুলবাড়িয়া কওমী মাদরাসা থেকে হাফিজি শেষ করা ইমরানও সরকার বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বড় ভাই তোফায়েলকে বাসায় রেখেই শুক্রবার ১৯ জুলাই ২০২৪ হাফেজ ইমরান আন্দোলনে যোগ দেয়। রাত না হলে বাসায় ফিরতো না। রাস্তায় হালকা খাবার খেতো। পরদিন শনিবার ২০ জুলাই ২০২৪ ভোর হতেই হাফেজ ইমরান ছুটে যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। অন্যদের সঙ্গে সাধ্যমতো মিছিলে শ্লোগান দেয়। ঢাকার রাস্তা-ঘাট অচেনা বিবেচনায় বিকেলে বাসায় ফিরলে বাবা-মা তাকে রুমে আটকে রাখে।

রোববার ২১ জুলাই ২০২৪ তারিখ সকালেও হাফেজ ইমরানকে রুমের ভেতর রেখে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু বাইরে যাবার জন্য ছটফট করছিলো ইমরান। অনেক কাকুতি-মিনতি করে তালা খুলে দেয়ার জন্য। কিন্তু কেউ তালা না খোলায় শেষে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে এ কিশোর। বাইরে গিয়ে এক কাপ চা ও চিপস খেয়ে ফিরে আসবে বলে ওইদিন বেলা দেড়টার দিকে বাসা থেকে বের হয়। সে যাওয়াই তার শেষ যাওয়া। সানারপাড় মোড়ে বেলা পৌনে ৩টার দিকে তাকে পেছন থেকে গুলী করে পুলিশ।

পুলিশের হেলমেট পরা সিভিল ড্রেসে থাকা ব্যক্তির চাইনিজ রাইফেলের গুলী তার পেছন থেকে ভেদ করে বুকের সামনে দিয়ে বের হয়। তাকে দ্রুত নেয়া হয় প্রো এ্যাকটিভ মেডিকেলে। চিকিৎসকরা তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার জন্য রেফার করেন। কিন্তু সেখানে আসার পথে রায়েরবাগে পুলিশ তাকে বহনকারী এ্যাম্বুলেন্স আটকে দেয়। এ্যাম্বুলেন্সে তার সাথে থাকা সহ আন্দোলনকারীদের মারধর করার পাশপাশি মোবাইল ফোনও কেড়ে নেয় পুলিশ। প্রায় আধাঘন্টা আটকে রাখায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা বিষয়টা জানতে পারেন রাত ১২টার দিকে। ঢামেক মর্গে গিয়ে ছেলের লাশ সনাক্ত করেন হাফেজ ইমরানের বাবা ছোয়াব মিয়া। শহীদ হাফেজ ইমরান জিরুন্ডা গ্রামে নানার বাড়ি থেকে পড়ালেখা করতো। তোফায়েল ও ইমরানের অপর ২ বোন জিনিয়া নাসরিন ও জেরিন নাসরিন দু’জনই শিক্ষার্থী। জিনিয়া নাসরিন পার্ক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কম্পিউটার টেকনোলজি বিষয় এ অষ্টম পর্বের ছাত্রী। জেরিন নাসরিন লাখাই মুক্তিযোদ্ধা ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী।

বাবা-মা’র অভিব্যক্তি : সোয়াব মিয়া বলেন, ‘আমি এক ছেলেকে হারালাম। আরেক ছেলের ভবিষ্যৎ কী হবে, আমি জানি না। এখন আর কিছু ভালো লাগে না। গুলীবিদ্ধ তোফায়েলের পড়াশোনা শেষ হলে আমরা গ্রামের বাড়িতে চলে আসব বলে ভাবছিলাম।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বেসরকারিভাবে অনেক সহায়তা তারা পেয়েছেন, তবে সরকারি কোনো সহযোগিতা পাননি। তবে খোঁজ নেওয়া হয়েছে এবং নাম-ঠিকানা জানতে চাওয়া হয়েছে। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, তোফায়েলের গায়ে যে ১৮টি গুলী আছে, এর দুটি খুলতে গেলে সমস্যা হতে পারে। বাকিগুলো তেমন সমস্যা নয়। তবে এখনো তিনি ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। কী করবেন, সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না। মা ইয়াসমিন আক্তার বলেন, “আমার বড় ছেলে গুলী খাওয়ার খবর পাই এক আত্মীয়ের মাধ্যমে। সোহরাওয়ার্দীতে তাকে পাই। তখন ইমরান তার ভাইকে বলে, ‘বেঁচে তো তুমি গাজী হয়ে গেছো, আর আমি শহীদ হবো।' এরপর থেকে সে আন্দোলনে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে।”

(ছবি: হাফেজ ইমরান ও সহোদর ভাই জুলাই যুদ্ধাহত তোফায়েল)

তিনি আরো বলেন, “দুই ভাই শুরু থেকেই আন্দোলনে যেত। আমি না করতাম। মা হিসেবে তো এভাবে তাদের যেতে দিতে পারি না। বলতাম, যদি তারা আন্দোলনে যায়, তাহলে আমিও তাদের সঙ্গে যাব। ইমরানের শিক্ষকদেরও বলেছি যেন তাকে যেতে না দেন। এর মধ্যে সে আত্মীয়ের বিয়েতে নারায়ণগঞ্জ আসে। তোফায়েল গুলী খাওয়ার পর তাকে এক প্রকার ঘরে আটকে রাখি। সে বারবার বলত, ‘কেন তোমরা আমাকে বন্দি করে রাখছো?’ একদিন সে ঠা-া (কোমল পানীয়) আনার কথা বলে বের হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় আসছে না দেখে অসুস্থ তোফায়েল ও তাদের বাবাসহ বেরিয়ে পড়ি। এক জায়গায় গিয়ে দেখি কিছু লোকের জটলা। কাছে গেলে অনেকে মোবাইল ফোনে দেখায় একটি ছেলে গুলী খেয়েছে। এটাই ছিল আমাদের ইমরান। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে তাকে মৃত দেখতে পাই। পরদিন তার লাশ গ্রামের বাড়িতে এনে দাফন করা হয়।” আহত ইমরানকে হাসপাতালে নিতে বাধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ইয়াসমিন আক্তার। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে তিনি জানান, স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল, পুলিশ এসে তাদের গাড়ি আটকায় এবং যাদের নিয়ে যাচ্ছিল তাদের পিস্তল ধরে পুলিশ। পরে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় তাকে মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরই মধ্যে ৪৫ মিনিট আটকে থাকার কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণেই তিনি মারা যায়।