রাজধানী
ধানমন্ডির সেই ধ্বংস হওয়া বাড়িটি দেখতে হাজারো মানুষের ভিড়
ভাঙচুরের পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ধ্বংস হওয়া সেই বাড়িটি দেখতে এখন ভিড় করছেন হাজারো মানুষ।
Printed Edition
নাছির উদ্দিন শোয়েব: ভাঙচুরের পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ধ্বংস হওয়া সেই বাড়িটি দেখতে এখন ভিড় করছেন হাজারো মানুষ। আওয়ামী লীগের দম্ভ চূর্ণ হওয়া শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটি বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ভাঙচুুরের পর সর্বশেষ কী অবস্থা তা দেখতে উৎসুক জনতা ভিড় জমাচ্ছেন। দেখতে আসছেন নারী, তরুণ-তরুণী এবং শিক্ষার্থীরা। কেউ কেউ এসেছেন বাড়িটির বর্তমান পরিস্থিতির সাক্ষী হয়ে থাকতে। টিভিতে দেখার পর কেউ এসেছেন সরাসরি পরিদর্শনে। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের এখনো আগ্রহ আর উৎসাহ এই বাড়ি নিয়ে। সেলফি তোলা ও ভিডিও করার পাশাপাশি অনেককে দেখা গেছে লোহালক্কড়, ভাঙাচোরা জিনিসপত্র নিতেও। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দেখা গেছে এমন চিত্র। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে বাড়িটি।
এদিকে কিশোরগঞ্জে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বাড়ি, তার ভাতিজা শরীফ কামালের ‘হাওড় রিসোর্ট’, দিনাজপুরে সাবেক হুইপ ইকবালুর রহিম ও সাবেক আপিল বিভাগের বিচারপতি এনায়েতুর রহিমের বাসভবন, মেহেরপুরে শেখ মুজিবের ম্যুরাল, নোয়াখালীতে সাবেক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমদের বাড়ি, নোয়াখালী-৬ আসনের সাবেক সংসদ মোহাম্মদ আলীর বাড়ি, রাজশাহী সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের বাসভবন, নওগাঁয় সাবেক খাদ্যমন্ত্রীর বাড়ি, মানিকগঞ্জে বঙ্গবন্ধু চত্বর, চৌমুহনী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আক্তার হোসেনের বাড়ি, সাভারে চেয়ারম্যানের বাড়ি, নারায়ণগঞ্জে শামিম ওসমানের বাড়ি, জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে শেখ মুজিবুর রহমানের দুটি ম্যুরাল, জামালপুরে অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনের বাড়ি, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের বাড়ি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বাড়ি, বগুড়ায় আওয়ামী লীগ, জাসদ ও জাপার কার্যালয় এবং চুনারুঘাটে মজিবের ম্যুরাল ভাঙচুুর করেছে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। বৃহস্পতিবার রাতে এসব ঘটনা ঘটে। কোথাও কোথাও ভাঙচুুরের পর অগ্নি সংযোগ ও বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের ভেঙে ফেলা বাড়ির সামনে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- তাদের অনেকের বক্তব্যই প্রায় একরকম। ভাঙা ভবনটির সামনে আসা আগতরা বলছেন, এই বাড়ি ভাঙা হয়েছে মূলত শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের কারণে। এছাড়াও তিনি গত ১৫ বছর এই জাতির ওপর যে জুলুম নিপীড়নের স্টিম রোলার চালিয়েছেন এতে ক্ষুব্ধ দেশের আপামর জনতা। সেই ক্ষত থেকে তারা তিন দিন আগে এই বাড়িটিতে আসেন, আগুন দেন ও ভাঙচুর করেন। শুধু তাই নয়, এই বিষয়টিকে স্মরণীয় করে রাখতে বৃহস্পতিবার রাতে এখানে জিয়াফতের আয়োজনও করা হয়েছিল। লালবাগ থেকে এসেছেন গোলাম রব্বানী। তিনি বলছিলেন, এই বাড়ি থাকার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। আমরা গত তিন দিন থেকে টিভি ও ইউটিউবে দেখেছি। আজ সরাসরি দেখতে আসলাম। বনশ্রী থেকে আসা রফিকুল ইসলাম বলছিলেন, হাসিনার বাবার হয়তো ২৪ এ এসে কোনো দোষ করেনি। যা করার তিনি ৭১ এর পরেই করেছেন। তবে মেয়ের কারণে সেই শাস্তি তিনি পেয়েছেন। এখন তার মেয়ে হাসিনার কৃতকর্মের কারণে বাবার বাড়িটার এই অবস্থা হলো। এজন্য হাসিনাই দায়ী।
সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সোয়া ১ পর্যন্ত অবস্থান করে দেখা গেছে, গত তিন দিন আগে যেমন মানুষর আগ্রহ ও উৎসাহ ছিল আজো তাই। এসেছেন নারী পুরুষ, তরুণ তরুণী, বৃদ্ধরা। কেউ এসে আবার ছবি তোলার পাশাপাশি ইট ও কনক্রিটের অংশগুলো নিয়ে যাচ্ছেন। তাদের ভাষ্য, সেগুলো তারা স্মৃতির অংশ হিসেবে বাসায় রেখে দেবেন। যেন তার পরের প্রজন্ম দেখতে পারেন হাসিনা স্বৈরাচার ছিল। ফলে তার ও তার বাবার বাড়ির পরিণতি কী হয়েছে।
ভবনটির সামনে পেছনে ও চারদিকে এখন মানুষ আর মানুষ। ভিড় করতে শুরু করেছে সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও ছাড়নো ব্যক্তিরাও। তারা কেউ কেউ লাইভ দিচ্ছেন। আবার এরই মাঝে এক দল লোককে ধ্বংসে পড়া ভবনের রড খুলে নিতে দেখা যাচ্ছে। ফাঁকে স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে কেউ কেউ ছবির পাশাপাশি ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে ছাড়ছেন। মূল ভবনের নিচ, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় উৎসুতক জনতা এখনো উঠছেন নামছেন। কারও মাঝে কোনো ভয় নেই। তবে এই ভবনটির পূর্ব, দক্ষিণ ও উত্তরের অংশ ভাঙার ফলে যে কোনো সময় ধ্বসে পড়তে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। এরপরও থেমে নেই লোকজনের ওঠানামা। একই চিত্র মূল ভবনের পূর্ব দিকের ভবনটিতেও। সেখানেও উৎসুক জনতা ভিড় করছেন। তবে দুপুর ১২টার পর পূর্ব দিকে থাকা ভবনটির দক্ষিণ কোণে লোকজন খড়কুটা, টিন ও কাঠ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। পরে সেই আগুনের ভিডিও ছবি কেউ কেউ ধারণ করছিলেন। কেন আগুন দিলেন জিজ্ঞাসা করতেই একজনের উত্তর ছিল, জ্বলে যাক। কেন এই অংশগুলোও থাকবে!
বাড়িটির পেছনের ছয়তলা ভবনের ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে লোহালক্কড় খুঁজে বের করছেন একজন। সেসব লোহালক্কড় তিনি ব্যাগের ভেতরে ঢোকান। কী করবেন জানতে চাইলে বলেন, এসব লোহালক্কড় তিনি ভাঙারি দোকানে বিক্রি করে দেবেন। ৩২ নম্বরের বাড়িটির ধ্বংসস্তূপ থেকে অনেকেই রড, লোহালক্কড় ও ইট নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের বেশির ভাগই নিম্নবিত্তের। গতকাল সকাল থেকে ৩২ নম্বরের বাড়িটি আনুষ্ঠানিকভাবে ভাঙার কাজ দেখা যায়নি। কয়েকজনকে হাতুড়ি দিয়ে কংক্রিটের বড় স্ল্যাব ভেঙে রড বের করে আনতে দেখা গেছে। একদল মানুষ করাত দিয়ে সেই রড কাটছেন। আবার তারা সেই রড নিয়ে যাচ্ছেন। কাউকে বাড়িটির ইট নিয়ে যেতেও দেখা গেছে।
এদিকে ৩২ নম্বরে ধ্বংস হওয়া শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির পাশে একটি নির্মাণাধীন ভবনে আয়নাঘর আছে এমন খবর চাউড় হয়ে যায় একদিন আগে। ভবনটির গ্রাউন্ড ফ্লোরের নিচে আন্ডারগ্রাউন্ডে আরও চারটি ফ্লোর ঘিরে এমন সন্দেহ তৈরি হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের সন্দেহ, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ডিজিএফআই, পুলিশ, র্যাবসহ বিশ্বস্ত প্রশাসনের আয়নাঘরের বাইরে দলীয় নেতাকর্মীদের দ্বারা নতুন এ আয়নাঘর তৈরি করেছে। তবে কেউ কেউ বলছেন, ফ্লোরগুলো বহুতল ভবনটির গ্যারেজ হতে পারে। এ ঘটনার একাধিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে উপস্থিত এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, নির্মাণাধীন ভবনটির গ্রাউন্ড ফ্লোরের নিচে আরও চার থেকে পাঁচতলা রয়েছে। পানি দিয়ে পূর্ণ থাকায় নিচে যেতে পারেননি তারা। তবে গতকাল পর্যন্ত এ খবরের সত্যতা পাওয়া যায়নি।
ভারতে পালিয়ে যাওয়া ক্ষমতাচ্যুত স্বের শাসক শেখ হাসিনার বক্তৃতা প্রচারের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা গত বুধবার রাতে ধানমন্ডির এই বাড়ি ঘিরে ব্যাপক বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে বাড়িটিতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বুধবার রাত ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা পর্যন্ত এক্সকাভেটর-বুলডোজার ও ক্রেন দিয়ে বাড়িটির অর্ধেকের বেশি অংশ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।