রাজধানী
ছাত্র-জনতার বিপ্লব : গৌরব গাঁথা
শহীদ খালিদ হাসানের শরীরে পুলিশের শটগানের ৭১ গুলীর চিহ্ন
আন্দোলনকারীদের ধাওয়া করে সেই সময় পুলিশও আজিমপুর কোয়ার্টারে ঢুকে পড়ে গুলী চালায়। অথচ এলাকাটি সংরক্ষিত। খালিদ গুলীবিদ্ধ হয়ে শহীদ হোন।
Printed Edition
![khalid](https://static.dailysangram.com/images/khalid.original.png)
মুহাম্মদ নূরে আলম : একটা আশ্চর্য বিষয় খেয়াল করলাম, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহীদ ও আহতরা প্রায় ৯৯%-ই দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত এবং একেবারে সাধারণ পরিবারের। এরচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো এদের প্রায় প্রত্যেকের পরিবারই ধার্মিক ও ইসলামী ভাবধারায় জীবন পরিচালনা করতেন। তেমনই একটি পরিবারের সন্তান শহীদ খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ। তার বাবা কামরুল হাসান ‘‘হাফেজ আব্দুর রাজ্জাক মাদরাসা’র শিক্ষক। ঢাকার লালবাগে জন্মগ্রহণ করা খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ ধানম-ি আইডিয়াল কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। বৃহস্পতিবার ১৮ জুলাই ২০২৪ বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে ছয়টার মধ্যে নামায শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। আন্দোলনকারীদের ধাওয়া করে সেই সময় পুলিশও আজিমপুর কোয়ার্টারে ঢুকে পড়ে গুলী চালায়। অথচ এলাকাটি সংরক্ষিত। খালিদ গুলীবিদ্ধ হয়ে শহীদ হোন। শটগানের অন্তত ৭১টি ছররা গুলীর চিহ্ন ছিল খালিদের শরীরে। শিশু বয়স থেকেই ক্রিকেট খেলার প্রতি আগ্রহ ছিল খালিদ হাসান সাইফুল্লাহর। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তার শখ ও ইচ্ছা পূরণের চেষ্টায় কমতি ছিল না পরিবারের। ক্রিকেটে তার প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ে পাড়া-মহল্লায়। আন্তঃস্কুল ক্রিকেট খেলায় চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল। ভালো ব্যাটিং করত। ইচ্ছা ছিল ক্রিকেটার হওয়ার। তবে পুলিশের ছোড়া বুলেটে সে স্বপ্ন মুহূর্তেই ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। কথাগুলো বলেই সাইফুল্লাহর বাবা কামরুল হাসান কান্নায় ভেঙে পড়েন। শহীদ খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ’র বাবা একটি টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে জানান, লাশ নিয়ে মিছিল করার ভয়ে শহীদ খালিদ সাইফুল্লাহ’র লাশ দিতে চায়নি পুলিশ। কামরুল হাসান বলেন, ‘প্রচ- মিশুক ছেলে ছিল খালিদ। সে আমাদের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। খুবই মেধাবী ছাত্র ছিল।’
নতুন প্রজন্মের বীর : বৃহস্পতিবার ১৮ জুলাই ২০২৪ বিকেল ৬টায় লালবাগ থানাধীন আজিমপুর সরকারি আবাসিক এলাকার ৭ নম্বর ভবনের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে সরাসরি গুলী চালানো হয়। এতে আইডিয়াল কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ গুলীবিদ্ধ হন। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। বড় ছেলে হারানোর শোকে পাথর হয়ে যাওয়া বাবার মুখে তেমন কোন কথা নেই। প্রায় সাড়ে ৬ মাস চলে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারেননি তিনি। এছাড়াও পরিবারের অন্য সদস্যদেরও একই অবস্থা। কামরুল হাসান জানান, খালিদ প্রথম দিন থেকেই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু সেদিন আজিমপুর ছাপড়া মসজিদে আসরের নামায পড়তে লালবাগের আমলিগোলার বাসা থেকে বের হয়েছিলেন খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ।
যেভাবে শহীদ হন : বৃহস্পতিবার ১৮ জুলাই ২০২৪ জুলাই বিপ্লবের সময় রাজধানী ঢাকার আজিমপুর সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারের মসজিদে আসরের নামায পড়তে লালবাগের আমলিগোলার বাসা থেকে বের হয়েছিলেন খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ। বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে ছয়টার মধ্যে নামায শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। আন্দোলনকারীদের ধাওয়া করে সেই সময় পুলিশও কোয়ার্টারে ঢুকে পড়ে।
তারা এ সময় গুলী করে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন। শটগানের অন্তত ৭১টি ছররা গুলীর চিহ্ন ছিল খালিদের শরীরে। শহীদ খালিদের বাবা কামরুল হাসান বলেন, “মাকে বলে যায় মসজিদে আসরের নামায পড়তে যাচ্ছি। রাতে এগারোটায় চেম্বার শেষ করে বাসায় আসার পর ওর মা বলে নামায শেষ করে এখনো বাসায় ফেরে নি সাইফুল্লাহ।” “আমি ওর মোবাইলে ফোন করি। অপরিচিত একজন ফোন ধরে আমাকে আমলিগোলা মক্কা হোটেলের সামনে যেতে বলে। সেখানে গেলে ছেলের মোবাইল হাতে দেয় আমাকে। এমনকী আমার ছেলের নামও ওরা জানত না। ওরা আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়।” পরে তাকে মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে অনেকগুলো একই বয়সী ছেলের লাশ দেখতে পান তিনি। সেখানেই নিজের ছেলের দেহ শনাক্ত করেন কামরুল হাসান। “অনেকগুলো লাশ একই বয়সের। ১৬ থেকে ১৮ বছরের অনেকগুলা লাশ। আমার ধারণা প্রায় ১৮/১৯টা লাশ ছিল ছোট্ট একটা রুমে গাদাগাদি করে। একপাশে ওর লাশটাকে খুঁজে পেলাম। ছেলের গায়ে খয়েরি পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা, টুপি ছিল কেউ খুলে নেয়নি”, পরে ফরিদপুরে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয় খালিদকে।
কামরুল হাসান বলেন, কতটা নির্মম, নির্দয়, পাষাণের মতো খালিদ সাইফুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে। তার শরীরে ৭১টি গুলীর চিহ্ন ছিল। প্রথমে স্থানীয় সংসদ সদস্য সোলায়মান সেলিমের নির্দেশে তার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা আমার সন্তানের মাথায় গুলী করে। তারপর স্থানীয় কাউন্সিলর মানিকের নির্দেশে ৬/৭ জন পুলিশ দৌড়ে এসে ২ থেকে ৩ ফুট দূরত্ব থেকে খালিদের বুকে ও পেটে ৭১ টি গুলী করে। ছাত্ররা যখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল তখন ইরফান সেলিম ও কয়েকজন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাধা দেয়। এক পর্যায়ে সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
জুলাইয়ের ১৮ তারিখ রাত থেকে বাসা, থানা, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ ঘোরাঘুরি করে আমার ছেলের লাশ হাতে পাই ২১ জুলাই। পরে জুলাইয়ের ২২ তারিখ ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার সোড়ইবাড়ি কবরস্থানে তাকে দাফন করি।
নির্মম এসব হত্যাকা-ের বিচার বাংলার মাটিতেই হতে হবে উল্লেখ করে খালিদের বাবা বলেন, কোনও সন্ত্রাসী যাতে আর বাংলার মাটিতে তৈরি না হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে বলতে চাই, বাংলার মসনদে আর কোনো স্বৈরাচারকে দেখতে চাই না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন তাদের জাতীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। প্রত্যেক শহীদের পরিবার ১ কোটি করে টাকা করে পাক এবং তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হোক।
ঘটনা নিয়ে মামলা : খালিদ গুলীবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় তার বাবা কামরুল হাসান ১৯ আগস্ট ২০২৪ লালবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সংসদ সদস্য হাজি সেলিমসহ ৫২ জনকে আসামী করেছেন তিনি।
নানা নাটকীয়তার পর সাইফুল্লাহ হত্যা মামলার আবেদন গ্রহণ : জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সময় নিহত শিক্ষার্থী সাইফুল্লাহ হত্যা মামলার আবেদন গ্রহণ করেছে লালবাগ থানা। মামলার আবেদনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক সাংসদ অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামসহ ৯১ জনকে আসামী করা হয়েছে। আবেদন গ্রহণের আগে দিনভর চলে নানা নাটকীয়তা। আন্দোলনে গিয়ে গত ১৮ জুলাই রাজধানীর আজিমপুরে পুলিশের গুলীতে মারা যান কলেজ শিক্ষার্থী সাইফুল্লাহ। এর এক মাস পর লালবাগ থানায় মামলা করতে আসেন তার বাবা। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর শুরু হয় নাটকীয়তা।
শনিবার (১৭ আগস্ট ২০২৪) মধ্য রাতে বাবা কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, রাত প্রায় সাড়ে ১২টা বাজে। কিন্তু এখনও মামলা নেয়া হয়নি। বিভিন্নভাবে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। একটা মামলা নিয়ে এত হয়রানি হতে হয়, সেটা আমি কখনও জানতাম না। এদিকে মামলার আবেদন নিতে দেরি করায় থানা ঘেরাও করে রাখে উত্তেজিত জনতা। পরে সেনাবাহিনীর মধ্যস্থতায় স্বাভাবিক হয় পরিস্থিতি। এর ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় পর আবেদন গ্রহণ করে পুলিশ।
আইনজীবী মো. মুজাহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, এই মামলার এজাহার কপিসহ মোট ১২ পাতা গ্রহণ করেছেন ডিউটি অফিসার। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, রোববার মামলাটি এজাহারভুক্ত হবে। মামলার এজাহারে প্রধান আসামী করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এ ছাড়াও সাবেক সাংসদ অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামসহ ৯০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আসামী করা হয়েছে আরও দেড়শ’ থেকে ২০০ জনকে।